এম এ লতিফ নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হলেও বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের টিকিট। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। চট্টগ্রাম-১১ আসনে টানা চারবারের এমপি হয়ে সবকিছুই নেন নিজের নিয়ন্ত্রণে। এ নির্বাচনি এলাকায় রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস হাউস, ইপিজেড, বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম চেম্বার, তেল শোধনাগারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ এলাকাকে দেশের অর্থনীতির হৃৎপি- বলা হয়। ১৫ বছর এ হৃৎপিন্ডে একচ্ছত্র দাপট দেখিয়েছেন এম এ লতিফ। গত দেড় দশকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন সুযোগসন্ধানী এই ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। এর বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত লতিফ এখন একাধিক মামলায় কারাগারে।
চেম্বারে ছিল একক আধিপত্য : চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে এম এ লতিফের ছিল একক আধিপত্য। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ পর্যন্ত এই সংগঠনকে তিনি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছিলেন। চেম্বারে বছরের পর বছর তার ইশারায় ভোটবিহীন কমিটি তৈরি হতো। যেখানে স্থান পেতেন কেবল তার ঘনিষ্ঠরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পর থেকে চেম্বারকে শতভাগ নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন লতিফ। মাহবুবুল এফবিসিসিআই সভাপতি হলে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে ডিঙিয়ে লতিফ তার ছেলে ওমর হাজ্জাজকে সভাপতি ও ওমর মুক্তাদিরকে ভোট ছাড়াই পরিচালক নির্বাচিত করেন। অভিযোগ আছে, লতিফের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের কারণে সর্বশেষ কমিটির পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন সৈয়দ এম তানভীরসহ একাধিক পরিচালক। গত দেড় দশকে চেম্বারের যে কোনো ইস্যুতে কেউ লতিফের কথার বাইরে গেলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। চেম্বারের অর্থায়নে নির্মিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণ, ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া, বাণিজ্য মেলার স্টল বরাদ্দ দেওয়া সবকিছুই ছিল এম এ লতিফ ও তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নুরুল হক বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী চিটাগাং চেম্বারকে ১৭ বছর স্বৈরশাসনের আজ্ঞাবহ করে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করা হয়েছে। এ দায় এম এ লতিফ এড়াতে পারবেন না। ভোট ছাড়া টানা পাঁচটি কমিটি হয়েছে। তিনি যেভাবে চাইতেন সেভাবেই সবকিছু হতো। এর বাইরে কিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না।’
বন্দর, নদী, ব্যবসাবাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার : চট্টগ্রাম বন্দরে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়া, যন্ত্রপাতি সরবরাহ, নিয়োগ, বদলিতে সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ ছিল লতিফের বিরুদ্ধে। বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসে তার একটি প্রতিষ্ঠানও নিয়োজিত ছিল। এ ছাড়া বন্দর ও কর্ণফুলী নদীতে লতিফের ছত্রছায়ায় অবৈধ মালামাল, চোরাই তেলসহ কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন তার অনুসারীরা। চট্টগ্রাম বন্দরের ঠিকাদার আওয়ামী লীগ নেতা রোটারিয়ান মো. ইলিয়াস বলেন, ‘নিজের পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া কাউকে বন্দরে ঠিকাদারি কাজ করতে দিতেন না লতিফ। নিজের লোকজনকে কাজ পাইয়ে দিতে তিনি অন্য ঠিকাদারদের নানাভাবে হয়রানি করতেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লতিফের ঘনিষ্ঠ অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান চৌধুরী জিএম ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিভিন্ন স্ক্র্যাপ কাঠ ও মালামাল বের করতেন। এসব মালামাল বের করার আড়ালে বন্দরের কয়েকজন অসাধু কর্মচারীর সহযোগিতায় অবৈধ ঘোষণায় আমদানি হওয়া বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ পণ্য ট্রাকে করে পাচার করত একটি সিন্ডিকেট। ২০১৪ সাল থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ২৫-৩০টি ট্রাকে করে মালামাল বের করে আমদানিকারকের দেওয়া নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিত এই সিন্ডিকেটটি। এসব ট্রাকে হাজার কোটি টাকার পণ্য পাচার হলেও বোঝার সুযোগ ছিল না। এই সিন্ডিকেটের মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন লতিফের দুই ভাতিজা সোহেল ও দস্তগীর। এদের সঙ্গে পুরো বিষয়টি দেখভাল করতেন নগর যুবলীগ নেতা দেবাশীষ পাল দেবু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রাজীবসহ আরও কয়েকজন। লতিফের ছত্রছায়ায় কর্ণফুলী নদীতে চোরাই তেলের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলে ছিল শুক্কুর নামের এক চোরাই তেলের কারবারি। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জন্য আমদানি করা তেল বোঝাই ট্যাংকারগুলো থেকে তেল চুরি করে সরিয়ে নিত এই সিন্ডিকেট। শুক্কুর একসময় কর্ণফুলী নদীতে মাঝি হিসেবে কাজ করলেও চোরাই তেলের বাণিজ্য করে কোটিপতি বনে যান। এই অবৈধ ব্যবসা থেকে শুক্কুর লতিফকে প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকার বেশি কমিশন দিত বলে দাবি করেছে একটি সূত্র।
ভূমি দখলে ছিলেন বেপরোয়া : লতিফের প্রত্যক্ষ প্রভাব কাজে লাগিয়ে পতেঙ্গা এলাকার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পেছনে বন্দরের অন্তত ৪ একর জায়গা গত কয়েক বছর ধরে দখলে রেখেছিলেন তার ঘনিষ্ঠ অনুসারী ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ কলেজের সাবেক ভিপি জাহেদ হোসেন খোকন ও আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর। কর্ণফুলী নদী থেকে সংগ্রহ করা চোরাই তেল সেখানে নিয়ে মজুত করে পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হতো। এখান থেকেও প্রতি মাসে লতিফ ১০ লাখ টাকার বেশি কমিশন পেতেন বলে দাবি করেছে আরেকটি সূত্র। এ ছাড়া ইপিজেড গেট থেকে কলসীর দিঘিরপাড় পর্যন্ত রেল বিটের পাশের বেশ কিছু খাস জায়গা দখল করে ২ শতাধিক অস্থায়ী দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিা আরেকটি সিন্ডিকেট। যার নেতৃত্বে ছিলেন লতিফের ঘনিষ্ঠ অনুসারী যুবলীগ নেতা হাসানুজ্জামান সোহেল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাকের আহমেদ খোকন, আজিজ, রানাসহ কয়েকজন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে মুন্সীগঞ্জের চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে গ্লোব শিপইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিযোগ আছে লতিফ পরিবারের বিরুদ্ধে।