ঋণের সুদহার বাড়ায় বেড়েছে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। এতে উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। এই সমস্যা সমাধানে সুদহার নির্ধারণে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা থাকা দরকার বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, বারবার সুদহার পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যবসাবাণিজ্যে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে সুদহার কমাতেই হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে উন্নত দেশগুলো শুধু ভোক্তা ঋণের সুদ বাড়ায়, শিল্পঋণের নয়।
কিন্তু আমাদের দেশে সব ধরনের ঋণের সুদ বাড়ানো হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের মতে, ক্রমাগত ঋণের সুদহার বাড়ানোর কারণে বিরাজমান কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ হয়েছে আরও দুর্দশা; যা চলমান সংকট আরও ঘনীভূত করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসাবাণিজ্যে স্থায়ী মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন শিল্পমালিকরা। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত কয়েক মাস ধরেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে নীতি সুদহার। সবশেষ ২৪ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রেপো রেট দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থ ধারের খরচ বাড়বে। এতে আমানত ও ঋণের সুদহারও বেড়েছে। বর্তমানে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। এতে ব্যবসা করে মুনাফা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা করে বিশ্বের কোনো দেশে মুনাফা করা যায় না। এ পরিমাণ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা ছোট বা বড় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অর্থায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক এই সভাপতি ‘শুধু প্রবাসী আয় এবং দাতাদের ঋণ ও সহায়তায় দেশ চলবে না। ব্যবসায়ীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের (ব্যবসায়ীদের) কথা বলার একটা জায়গা লাগবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ ঢাকা চেম্বার কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেছেন, ১৫ শতাংশের বেশি ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই দুঃসাধ্য, তবে উদ্যোক্তাদের সেটা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কাস্টম হাউসগুলোর দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যেটি নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে ফিন্যান্সিয়াল রিফর্মস কমিটি গঠনের পাশাপাশি অটোমেশন নিশ্চিত করা জরুরি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ঋণের সুদহার বাড়ার কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাওয়ায় পণ্য উৎপাদনের খরচও বেড়েছে। এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানো হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়িয়ে কোনো কাজ হবে বলে আমি মনে করি না। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মানে জিনিসপত্রের দাম কমানো। আমাদের দেশের অধিকাংশ ঋণ নেয় বড় বড় কোম্পানি, ব্যবসায়ী গ্রুপ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগত ঋণ বাংলাদেশে অনেক কম। এটা বিদেশে অনেক বেশি। সেই কারণে বিদেশে মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানো হয়। আমাদের দেশে যে পাউরুটি বানায়, সে যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। পাউরুটি বানাতে তার খরচ বেড়ে যাবে। আলটিমেটলি সব জিনিসেই তো খরচটা বাড়ছে। এ জন্যই উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বিনিয়োগও ইতোমধ্যে কমে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এটা উন্নত দেশ বা ইউরোপ আমেরিকা নয়। যেখানে পরিবারের সবাই কাজ করেন। বাংলাদেশে পাঁচ সদস্যের এক পরিবারের আয় করে দু-একজন। ফলে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এজন্য আমাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পায়নের জন্য সহায়ক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সাময়িক কৌশল হতে পারে। তবে এটা একমাত্র কৌশল হতে পারে না। এর সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট নিরসন করতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ-গ্যাস ও আনুষঙ্গিক সেবাগুলোর খরচ কমাতে হবে। অন্যথায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় কমানো যাবে না। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।