শেরপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নতুন করে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে সাতজন হয়েছে। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ছনধরা ইউনিয়ন পুরোটাই প্লাবিত হয়েছে।
তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা, কাকনী, তারাকান্দা ও ঢাকুয়া ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। হালুয়াঘাটে প্রায় ৮০-৯০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নেত্রকোনার পূর্বধলায় বাড়িঘর তলিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। অপরদিকে কুমিল্লার দক্ষিণের তিনটি উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার দুর্ভোগের মাঝে আবার পানি বেড়েছে। বাড়ছে রোগব্যাধি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
শেরপুর : শেরপুর জেলার সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদীর বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি উন্নতি হওয়া শুরু হয়। তবে উঁচু অঞ্চল থেকে পানি নেমে আসায় নকলা ও শেরপুর সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আর বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়র বোর্ড। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত মানুষ তাদের আশ্রয়স্থল বাড়িতে ফেরা শুরু করেছে। বাড়ি ফিরে ধ্বংসস্তূপ দেখে চোখে অশ্রু ঝরছে ক্ষতিগ্রস্তদের।
এদিকে, শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে বন্যার পানির স্রোতে নিখোঁজ হওয়া দুই ভাইয়ের লাশ গতকাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে তিন দিনের বন্যায় মোট সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নালিতাবাড়ী থানার ওসি ছানোয়ার হোসেন লাশ উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মৃতরা হলেন- হাতেম আলী (৩০) ও তার ভাই আলমগীর হোসেন (১৮)। তারা অভয়পুর গ্রামের মৃত বাছির উদ্দিনের ছেলে। এর আগে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে ইদ্রিস আলী, খলিলুর রহমান ও বাঘবেড় বালুরচর গ্রামের ওমিজা বেগমসহ পাঁচজন। টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুরের সবকটি পাহাড়ি নদীর পানি এখনো বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই প্রবাহিত হচ্ছে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি বের হচ্ছে তবে স্রোত কম। সারা জেলায় ৪ লাখ লোক বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। ফসল গবাদি পশুসহ কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, পানি নেমে যাওয়ার পর হিসাব ও পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
বন্যা দুর্গতদের পাশে প্রশাসন, সেনা, বিএনপি, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ব্যাপক হারে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, অন্তত ১২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ১২টি স্পটে রান্না করা খিচুড়ি বিলি করা হয়েছে। জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে ১০ হাজার বন্যার্ত মানুষকে নগদ অর্থ ও খাবার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেছেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। আজ (গতকাল) রাতের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। বন্যা-পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলা করতে সরকার এখনই কাজ শুরু করতে নির্দেশনা দিয়েছে।
ময়মনসিংহ : শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকা থেকে মালিঝি নদী হয়ে ফুলপুরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। গত তিন দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট এ বন্যায় ফুলপুর ও তারাকান্দার বিভিন্ন নিচু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়েছেন ১৫ গ্রামের ৫ হাজারের বেশি মানুষ। ওই দুই উপজেলার ৪ হাজার ২৬০ হেক্টর আমন ধানের খেত বানের পানিতে তলিয়ে গেছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।
ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম আরিফুল ইসলাম জানান, ছনধরা ইউনিয়ন পুরোটাই প্লাবিত হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম সকাল থেকে চলছে। ইতোমধ্যে কয়েক শ মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোও প্রস্তুত করা হয়েছে। এই ইউনিয়নের মেরীগাই গ্রামের মুনাওওয়ার হোছাইন জানান, গ্রামীণ রাস্তায় কোমর পানি। পানিতে ব্যাপক স্রোত। যাতায়াতে এলাকাবাসী ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছেন। তাছাড়া দুর্গত এলাকায় রান্নাবান্নাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ সীমাহীন কষ্টে আছে।
অপরদিকে তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা, কাকনী, তারাকান্দা ও ঢাকুয়া ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অরুণিমা কাঞ্চি সুপ্রভা শাওন জানান, জলাবদ্ধতায় ৬০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৫৬০ হেক্টর ধান ও ৪০ হেক্টর শীতকালীন আগাম সবজি রয়েছে।
ময়মনসিংহের অপর উপজেলা হালুয়াঘাটের কৈচাপুর ইউনিয়ন ও নড়াইল এলাকার পানিবন্দিদের উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল আটকে পড়াদের উদ্ধার কার্যক্রম, শুকনো খাবার বিতরণ করেন সেনা সদস্যরা। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রায় ৩ শতাধিক বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রসহ নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রেডক্রিসেন্ট সদস্য দল ও উপজেলার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যা দুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে শুকনো খাবার ও ত্রাণ সামগ্রী।
ডুবেছে প্রায় ৮০-৯০টি এলাকা। এর মধ্যে উপজেলা সদরের প্রত্যেক পাড়া-মহল্লা। পানিতে তলিয়ে গেছে হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক সড়ক, হালুয়াঘাট থানা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিষদ, খাদ্য গুদাম, ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনের অংশ, জয়িতা প্রাঙ্গণসহ পৌরশহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী উপজেলার কৈচাপুর ও নড়াইল, জুগলী ও ধুরাইল ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে এখনো কয়েক হাজার পরিবার রয়েছে পানিবন্দি অবস্থায়। ভেসে গেছে এসব এলাকার মাছের ঘেরসহ সবজি আবাদ।
নেত্রকোনা : টানা বর্ষণ আর ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে নেত্রকোনার পূর্বধলা। উপজেলার জারিয়া নাটেরকোনার কালিদাস নামক বাঁধ ভেঙে গ্রামের ভিতরে পানি ঢুকে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কংস নদের পানি বেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে দুর্গাপুর কলমাকান্দা সদরের অনেক নিচু এলাকা তলিয়ে গেছে। স্থানীয়দের ধারণা অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ময়মনসিংহ জারিয়া রেললাইনের আধা কিলোমিটার অংশ।
কুমিল্লা : কুমিল্লার দক্ষিণের তিনটি উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার দুর্ভোগের মাঝে আবার পানি বেড়েছে। বাড়ছে রোগ ব্যাধি। শনিবার (৫ অক্টোবর) পর্যন্ত টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার উত্তরদা ও দক্ষিণ মুদাফরগঞ্জ। এ ছাড়া মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে পানি বেড়েছে। সেই সঙ্গে নাঙ্গলকোট উপজেলার নিম্নাঞ্চল জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নেও পানি বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৬ আগস্ট দক্ষিণ কুমিল্লায় বন্যাকবলিত হয়। সেটি ৫১ দিন ধরে বহাল রয়েছে। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন অংশে খালবিল ও নদী দখল হয়ে গেছে। এতে পূর্বের বন্যার পানি কিছু কমেছে। বন্যার পূর্বের পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি যোগ হয়েছে।