রাজধানীসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে ১৪ প্লাটুন বিজিবি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সরকারি ভবন ও কৌশলগত স্থানে বসানো হয়েছে পুলিশ এবং র্যাবের অতিরিক্ত চেকপোস্ট। একই সঙ্গে মঙ্গলবার রাত থেকে চলছে তল্লাশি অভিযান। গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৪৪ নেতা-কর্মীকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘নাশকতার চেষ্টা করলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের লকডাউনের নামে অরাজকতা ও নাশকতা ঠেকাতে পোশাকে ও সাদা পোশাকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীতে মাঠে নামছে ১৮ হাজারের বেশি পুলিশ ও গোয়েন্দা। বাড়ানো হয়েছে টহল ও নজরদারি। যে কোনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিশেষ বাহিনী সোয়াট।’
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনে রাজধানীতে একাধিক স্থানে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় উত্তেজনা বাড়ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণা কেন্দ্র করে আজ সারা দেশেই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর এয়ারপোর্ট, আবদুল্লাহপুর, ধানমন্ডি ৩২, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কাকরাইল, হাই কোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ১২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকার প্রবেশপথ ও বিভিন্ন মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে, যাচাই করা হচ্ছে কাগজপত্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, সমাজমাধ্যমে ‘লকডাউন’, ‘গণসমাবেশ’, ‘হামলা’, ‘অগ্নিসংযোগ’ ইত্যাদি গুজব ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
এ ছাড়া মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ১৩ নভেম্বর কেন্দ্র করে কোনো আতঙ্কের কারণ নেই। পর্যাপ্ত পুলিশ মাঠে থাকবে। কেউ বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে কঠোর হাতে দমন করা হবে।
বিজিবি মোতায়েন : ঢাকা ও আশপাশ জেলার নিরাপত্তা জোরদারে ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবি সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
রাতভর অভিযান, ৪৪ গ্রেপ্তার : গতকাল গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, কার্যক্রম স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৪৪ নেতা-কর্মীকে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ সারা দেশে খোলা শপিং মল ও দোকানপাট : সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যেও আজ সারা দেশে শপিং মল ও দোকানপাট খোলা থাকবে। বাংলাদেশ দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ও ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংগঠনটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও জনজীবনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সারা দেশের দোকান ও বিপণিবিতান যথারীতি খোলা থাকবে।
গণপরিবহন চলবে : কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ঘোষিত ১৩ নভেম্বরের লকডাউনের সময় গণপরিবহন চলবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। একই সঙ্গে সংগঠনটির পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সতর্কভাবে চলাচলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. জোবায়ের মাসুদ। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবারও সড়কে গণপরিবহন চলবে। তবে কোথাও কোনো বাসে অগ্নিকাণ্ড না ঘটে সেজন্য পরিবহন মালিক এবং প্রতিটি বাস টার্মিনালের সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
মাঠে থাকবে কয়েকটি দল ও ছাত্র সংগঠন : আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে রাজপথে প্রতিহত করতে সক্রিয় থাকবে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন। তাদের নাশকতা ও অপতৎপরতা ঠেকাতে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবির। গতকাল পৃথক পৃথক কর্মসূচিতে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে দল ও সংগঠনগুলো।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কারা দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনি দৌড়ে নেই, দেশে নেই; সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে কেউ করতে পারে।
এদিকে জামায়াতসহ আট দলের নেতারা ফ্যাসিবাদী শক্তির নাশকতা-অপতৎপরতা প্রতিরোধে আজ (বৃহস্পতিবার) মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তির নাশকতা ও অপতৎপরতা প্রতিরোধে আট দলের নেতা-কর্মীরা দেশব্যাপী রাজপথে অবস্থান করবে।
‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এ আহ্বান জানান সংগঠনটির সভাপতি রিফাত রশিদ। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারিক কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধঘোষিত ফ্যাসিস্ট ও জঙ্গি সংগঠন আওয়ামী লীগের দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা প্রতিরোধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগর, জেলা ও সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এদিকে, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি ঘিরে যে কোনো ধরনের নাশকতা বা নৈরাজ্যের জবাব দিতে প্রস্তুত ইসলামী ছাত্রশিবির। এদিকে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের লকডাউন ঘিরে দেশের মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আজ সব দল মাঠে থাকবে। আর আওয়ামী লীগকে মাঠে ঠেকাতে এনসিপির এক হাসনাত আবদুল্লাহই যথেষ্ট। এটা নিয়ে আপনাদের কোনো টেনশন নেই। দেশে তাদের মরণ হয়ে গেছে।