শিরোনাম
শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখা

সভ্যতার শুরু পরিবার থেকে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, মানব জাতির আয়ু ততদিন, পরিবার থাকবে যতদিন। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্ব হারাবে মানব সভ্যতা। তাই প্রতিটি ধর্মই পারিবারিক বন্ধন মজবুত করার ওপর জোর দিয়েছে। হালে পরিবারবিমুখ পশ্চিমা সভ্যতার অপ-সংস্কৃতি আমাদের দেশেও শেকড় গাড়ছে ধীরে ধীরে। ভাঙছে সংসার। বাড়ছে লিভ টুগেদার। শান্তির নীড়হারা এ মানুষগুলো এক সময় অনুভব করে-পৃথিবীতে তার মতো একা কেউ নেই।  একাকিত্ব থেকে বাঁচতে বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো আরেকটি ভুল পথ। বিপন্ন পরিবার ও জীবন পেতে না চাইলে পরিবারে শান্তি বজায় রাখুন।  সুখী পরিবার গড়ার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন-

 

নারী-পুরুষের প্রেমের বন্ধন পরিবার

প্রেমের কারিগর আল্লাহ দুনিয়াজুড়ে প্রেমের মেলা সাজিয়েছেন। আল্লাহতায়ালার এক নাম ‘রহমান’। আরবি ভাষারীতি অনুযায়ী ‘রহমান’ শব্দটি ইসমে ফায়েলে মুবালাগাহর সিগাহ। রহম থেকে এসেছে রহমান। অর্থ অত্যধিক দয়ালু। খুব বেশি প্রেমময়। রহমান তার প্রেম সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা প্রেম নারী-পুরুষের হৃদয়ে ঢেলে দিলেন। মন নদীতে প্রেমের জোয়ায়ের শুরুটা এভাবেই। তারপর বিয়ে। নদীর দুই কূল থেকে নারী পুরুষ এখন এক হলো। নতুন সৃষ্টিতে দুনিয়া সাজাবে এ নবদম্পতি। পৃথিবী টিকিয়ে রাখার খোদায়ী এ পদ্ধতিকে আমাদের ভাষায় পরিবার বলে।

পবিত্র কোরআনে নারী-পুরুষের প্রেমের বন্ধনকে ‘আয়াত’ বলে উল্লেখ করেছেন আল্লাহতায়ালা। আয়াত শব্দের একটি অর্থ নিদর্শন। প্রতিটি সৃষ্টিই আয়াত। আল্লাহর কুদরত তথা অসীম ক্ষমতার ক্ষেত্রে আয়াত শব্দটির ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়। সুরা রুমে আল্লাহ তার বেশ কিছু আয়াত তথা বিশেষ নিদর্শনের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে আছে মানব সৃষ্টি, মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি, ভাষা বৈচিত্র্য, রাত-দিন ও ঘুম, বিদ্যুতের চমক, মধ্যাকর্ষণ শক্তি। মজার ব্যাপার হলো, মানব সৃষ্টির পরই আল্লাহ নারী-পুরুষের দাম্পত্যকে শিরোনাম করেছেন। এর মানে দাঁড়ায়- মহাকাশ, পৃথিবী, ভাষা বৈচিত্র্য, রাত-দিন ও মধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়েও রহস্যময় ব্যাপার পারিবারিক বন্ধন।

আর হবেই না বা কেন! কোথাকার কোন আবদুল্লাহর জীবনে আমাতুল্লাহ এসে তার হাসি গানের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। একজনকে ছেড়ে আরেকজনের বাঁচা দায়। কবি জসীমউদ্দীনের কবর কবিতায় দাদা নাতিকে বলছেন, শোনো দাদুভাই! তোমার দাদিজানকে এতটুকুন বয়সে ঘরে এনেছিলাম। নিত্যদিনের হাসিকান্নায় সে আমার প্রাণে মিশি গিয়েছিল। কবির ভাষায়- ‘এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সঙ্গে মিশে/ছোট-খাটো তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।’

কবি যেন সুরা রুমের ২১ নম্বর আয়াতের প্রতিধ্বনিই করেছেন। আল্লাহ বলেন, আল্লাহর মহিমার আরেকটি নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক মমতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীলদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় নিদর্শন রয়েছে।’

পবিত্র কোরআন স্পষ্টভাবেই বলছে, সঙ্গিনীর মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ হয়। আর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা আল্লাহ তৈরি করে দেন। প্রেমের এ বন্ধন আল্লাহর আয়াত। চিন্তাশীল-গবেষকদের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নারী-পুরুষ একে অপর থেকে যৌনসুখ লাভ করে ঠিকই, কিন্তু পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-মায়া-মমতা তাদের মন নদীতে জাগে না। এর বড় কারণ হলো, পরিবার প্রথাকে তারা দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে চায়। তারা বিয়েহীন লিভ টুগেদার সংস্কৃতি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চায়। এতে করে শারীরিক সুখ মিললেও আত্মার প্রশান্তি কিন্তু ধরা দেয় না। বিয়ের উদ্দেশ্য কেবল যৌনসুখ নয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘লিতাসকুনু ইলায়হা’। যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আরবি সুকুন বা সাকিনা শব্দের অর্থ প্রশান্তি পাওয়া। তৃপ্তি লাভ করা। পরিবারপ্রথা প্রয়োজনীয়তা এবং যৌক্তিকতার এটাই প্রথম এবং প্রধান কথা।

শারীরিক তৃপ্তি ও মানসিক প্রশান্তি ছাড়াও পরিবারের আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপকারের কথা আল্লাহ বলেছেন। ‘মাওয়াদ্দাহ ওয়া রহমাহ’। আরবি মাওয়াদ্দাহ মানে হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সমমর্মিতা, হৃদ্যতা। আর রহমাহ শব্দের অর্থ দয়া, মায়া, প্রেম। মানবজীবনে একটি অধ্যায় আসে যখন তার যৌবন ফুরিয়ে যায়, শক্তি কমে আসে, হাসপাতালে ছটফট করে, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথার ওপর ঝুলতে থাকে। তখন কিন্তু পরিবারশূন্য মানুষটির পাশে কেউ থাকে না। পৃথিবী থেকে বিদায়ের সময় তার বুক হাহাকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলতে চায়, হায়! কোথায় আজ সুখের দিনের বন্ধুরা!

কিন্তু যার পরিবার আছে, জীবনসঙ্গী আছে, বিপদের দিন, অসুস্থ বিছানায়, বার্ধক্যের জরাজীর্ণতায় সে অনুভব করে- এ দুনিয়ায় সে একা নয়। একজন মানুষ অন্তত তার পাশে আছে। সে দেখে পৃথিবীর সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের ভিড়ে গুটিকয়েক মানুষ তার জন্য চোখের জল ফেলছে। বুকভাঙা কান্না আটকে বারবার চোখ মুছছে। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র তার বিখ্যাত দেবদাস উপন্যাসে লিখেছেন, মরণ সবার জীবনেই আসে। কিন্তু যার মৃত্যুর সময় পাশে কোনো প্রিয়জন থাকে না, তার মতো হতভাগা পৃথিবীতে খুব কমই আছে। আমরা যেন হতভাগাদের কাতারে না পড়ি তাই আল্লাহ আমাদের পরিবারভিত্তিক জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন।

 

প্রেমের সুতোয় টান পড়েছে

বড় উদ্বেগের কথা হলো, শান্তি-সুখের ঠিকানা পরিবারগুলো এখন ক্রমেই অশান্তি-জাহান্নামে পরিণত হচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে, পারিবারিক সুখ-শান্তি আমাদের জীবন থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে। ডিভোর্স তো এখন মহামারীতে রূপ নিয়েছে আমাদের দেশে। পারিবারিক খুন-খারাবি এর আগে এতটা ভয়ঙ্কর কখনই হয়নি। পরকীয়ার বলি হচ্ছে সন্তান। স্বামীকে স্ত্রী আর স্ত্রীকে স্বামী খুন করছে অবলীলায়। বাড়ছে আত্মহত্যা। মাদক তো অনেক আগেই আমাদের ধ্বংসের গর্তে ফেলে দিয়েছে। মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, যে সমাজে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, ওই সমাজে মাদক-আত্মহত্যা-পরকীয়া মহামারীর মতো বেড়ে যায়। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এমন হচ্ছে? এর উত্তরে খুব স্বাভাবিকভাবেই আসবে কয়েকটি বিষয়। যেমন- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া কমে যাওয়া, দুজন দুজনকে সময় কম দেওয়া, একে অপরের প্রতি দায়িত্বহীনতা বেড়ে যাওয়া, অপসংস্কৃতির প্রভাব এবং ধর্মীয় অনুশাসন না মেনে চলা ইত্যাদি।

পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় থাকলে নারী-পুরুষ কেউই পরকীয়ায় জড়ায় না। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলছি না। বেশিরভাগ পরকীয়ার পিছনে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কোনো না কোনোভাবে দায়ী থাকেন। দুজনে যদি দুজনের শারীরিক-মানসিক এবং আত্মিক চাহিদার প্রতি সহমর্মিতা দেখায়, যদি একে অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকে- তাহলে ওই স্বামী বা স্ত্রী কখনো ভিন্ন চিন্তা মনে স্থান দেবে না।

পরকীয়ার দুয়ার বন্ধ করে দিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি অন্য নারী দেখে তোমাদের মনে কুধারণা জন্মে, তোমরা তোমাদের স্ত্রীর কাছে যাও, তার সঙ্গে সময় কাটাও। তাহলে তোমাদের মন থেকে পাপের ইচ্ছে চলে যাবে।’ মুসলিম। আরেকটি হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো বেগানা নারীর প্রতি যদি তোমাদের প্রেম জাগে, তাহলে জানবে এটা শয়তানের কাজ। এমন হলে তোমার স্ত্রীর কাছে যাও এবং তাকে সময় দাও, সে তোমার কামনা-বাসনা পূরণের জন্য বৈধ সঙ্গী।’ মুসলিম।

একইভাবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্বামী পছন্দ করে না এমন ব্যক্তিকে ঘরে জায়গা দিও না। যখন স্বামী বাইরে থাকবে, তখন পরপুরুষ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চল।’ বুখারি। অন্য হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘যে নারী ফরজ নামাজ এবং ফরজ রোজা যথাযথভাবে পালন করে এবং স্বামীর সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্ক বজায় রাখে আর লজ্জাস্থান হেফাজত করে- জান্নাতের আটটি দরজার যে কোনোটি দিয়ে চাইলে সে প্রবেশ করতে পারবে।’ তিরমিজি।

এ জন্য কম সামর্থ থাকলেও রসুল (সা.) পরিবার গঠনের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন এবং পরিবারবিমুখ চিন্তার বিরোধিতা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রসুল (সা.)-এর সঙ্গে জিহাদে অংশ নিতাম। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ ছিল। আমরা কয়েকজন রসুল (সা.)-এর কাছে বললাম, আমরা কি খাসি হয়ে যাব অর্থাৎ বিয়ে না করে সারা জীবন কাটাব? তিনি আমাদের কঠোরভাবে নিষেধ করে বললেন, কোনো মহিলার সঙ্গে একটি কাপড়ের বিনিময় হলেও বিয়ে করে নাও।

তারপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন- ‘ওহে ইমানদারগণ! পবিত্র বস্তুরাজি যা আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন সেগুলো হারাম করে নিও না আর সীমা লঙ্ঘন কর না, অবশ্যই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ সুরা মায়েদাহ : আয়াত ৮৭।

বুখারির অন্য বর্ণনায় রসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে যুবকের দল! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ রাখে, সে যেন বিয়ে করে এবং যে বিয়ের সামর্থ রাখে না, সে যেন ‘সওম’ পালন করে। কেননা, সওম যৌন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

 

 

হাদিসে পরিবারবিমুখ চিন্তার নিন্দা

ইমাম বুখারি (রহ.) তার সহি গ্রন্থে কিতাবুন নিকাহর ভূমিকায় সুরা নিসার ৩ নম্বর আয়াতে ‘তোমরা নারীদের মধ্য থেকে নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে কর’ উল্লেখ করেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর সনদে তিনি একটি হাদিস বর্ণনা করেন। রসুল (সা.)-এর খাদেম আনাস (রা.) বলেন, তিনজনের একটি দল নবীজির ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য নবীর স্ত্রীদের বাড়িতে এলো। যখন তাঁদের এ সম্পর্কে জানান হলো, তখন তারা ইবাদাতের পরিমাণ কম মনে করল এবং বলল, নবীর সঙ্গে আমাদের তুলনা হতেই পারে না। কারণ, তাঁর আগে ও পরের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় তাদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি সারা জীবন রাতভর সালাত আদায় করব। অপর একজন বলল, আমি সব সময় সওম পালন করব এবং কখনো বাদ দেব না। অপরজন বলল, আমি নারী সঙ্গ ত্যাগ করব, কখনো বিয়ে করব না।

এরপর রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের কাছে এলেন এবং বললেন, তোমরা কি তারা যারা এমন এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহভীরু এবং তোমাদের চেয়ে বেশি ইবাদতগোজার। অথচ আমি সওম পালন করি, আবার তা থেকে বিরতও থাকি। সালাত আদায় করি, নিদ্রা যাই এবং নারীদের বিয়েও করি।

 

ফিরে আসুক পারিবারিক বন্ধনের সোনালি দিন

রসুল (সা.) পারিবারিক সম্প্রীতির ব্যাপারে এত বেশি বলেছেন যে, হাদিস এবং ফিকহ শাস্ত্রে পরিবার নিয়ে আলাদা অধ্যায়, ভলিউমও রয়েছে। কোরআন পরিবার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছে কিন্তু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বাদ দেয়নি। সুরা নূরসহ বিভিন্ন সুরায় আল্লাহ বলেছেন, সামর্থবান নারী-পুরুষের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি। বিয়ের পর পারিবারিক বন্ধন এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখভালের কথা বলেছে কোরআন। সন্তান গর্ভধারন, দুধপান, বাবা-মার সঙ্গে ব্যবহার, সন্তানের প্রতি কর্তব্য এবং খুব প্রয়োজন হলে বিচ্ছেদ নিয়ম-কানুন কী হবে তা বিস্তারিত বলেছে কোরআন।

কিছু মানুষের ধারণা, জীবনের ব্যাপারে তারা পুরোপুরি স্বাধীন। কোনো বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করে না। তারা ধর্ম এবং স্রষ্টাকে পর্যন্ত অস্বীকার করে। তাদের একটি ভুল চিন্তা হলো, পরিবারের প্রয়োজন নেই। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও যেমন খুশি তেমনভাবে যৌনকামনা পূরণ করবে। লিভ টুগেটার করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ চিন্তাটি যে ভুল বাস্তবতা থেকে একটি চিত্র তুলে ধরছি।

সমকালীন একজন সুফি গবেষককে প্রশ্ন করা হলো- কেন বিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের একটি তরুণদের সম্মেলনে তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, আমি যদিও সুফি গবেষক, কিন্তু আমার পড়াশোনা বেড়ে ওঠা ঘোর নাস্তিকদের মধ্যে। এ ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ডিগ্রি নিয়েছি। আমি দেখেছি, একজন নারী যিনি যৌবনে বিয়ের কোনো গুরুত্বই অনুভব করেন না, বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বলে বিয়ে করলে এই হয় সেই হয়, নারীকে শিকলে বন্দী করা হয়, অধিকার ক্ষুণœ করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই নারীটি যখন চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশের কাছাকাছি চলে আসে এবং যৌবনের আবরণ তার দেহ থেকে পড়ে যায় তখন তাকে সেজেগুঁজে কোনো মদের দোকানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় কোনো ছেলে বন্ধুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। ছেলেটি তার সঙ্গে যৌনমিলন না করুক অন্তত পাশে বসে কথা বলুক, তার সঙ্গে সময় কাটাক এ জন্য হলেও একজন পুরুষের খুব প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ওই নারী। এ দৃশ্যটি আমার খুবই খারাপ লাগে। আমি বহু নারীকে জিজ্ঞেস করেছি, এখন তোমার কী মনে হয় বিয়ে ভালো নাকি উন্মুক্ত যৌনতা ভালো? চোখের পানি ছেড়ে তারা বলত, বিয়ে করলে আজ অন্তত পাশে কেউ না কেউ অবশ্যই থাকত। আমাদের জীবনের চরম ভুল ছিল বিয়ে না করা।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় একজন কবি বেশ আক্ষেপ করেই একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এক সময় যৌবন ছিল, মনে হতো বিয়ে করাটা বোকামি। এখন মনে হচ্ছে, বিয়ে না করেই ভুল করেছি। এ বয়সে একজন মানুষকে পাশে পাওয়া খুবই দরকার। আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি বিয়ে না করে কী ভুলটাই না করেছি। এখন এ বয়সে কে আর আমাকে বিয়ে করবে।

নবীজি (সা.) বিয়ের প্রতি যে ধরনের গুরুত্ব দিয়েছেন, তা থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়, বিয়েহীন সমাজ অন্তত মুসলমানের সমাজ নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজ ধীরে ধীরে বিয়েহীন, পরিবারবিমুখ হয়ে পড়ছে। এর নানাবিধও কারণ রয়েছে। তরুণরা বিয়ের প্রতি যতই বিমুখ হচ্ছে, ব্যভিচারের প্রতি ততই আগ্রহী হচ্ছে। এর পরিণাম বড়ই ভয়াবহ। আল্লাহতায়ালার শাস্তি থেকে বাঁচতে চাইলে, ভেঙে যাওয়া সমাজ ও পরিবারকে আবার দাঁড় করাতে চাইলে এখনই কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে ধর্মচিন্তকদের।

 

কোরআনে পরিবার গঠনের তাগিদ

ইসলামী সভ্যতা যে কয়টি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার অন্যতম ভিত্তি হলো পরিবার। পবিত্র কোরআন এবং রসুল (সা.)-এর জীবনের বড় অংশজুড়ে রয়েছে আদর্শ পারিবারিক জীবন গঠনের খুঁটিনাটি বিস্তারিত নির্দেশনা। আল্লাহ ভালো করেই জানেন মানব সভ্যতার জন্য পরিবারের বিকল্প নেই। তাই মানবজাতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ আল কোরআনুল কারিমে মানুষকে পরিবার গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। সুরা নূরে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত-সিঙ্গেল আছে তাদের বিয়ে করিয়ে দাও।’ বিয়েহীন সমাজ-সুস্থ-সুন্দর সভ্য সমাজ নয়- পাশ্চাত্যের বিকৃত জীবনাচারের দিকে তাকালেই তা সহজে বুঝতে পারা যায়। সেখানে মানুষ বিয়েকে বোঝা মনে করে। সন্তান ধারণ ও লালন-পালন তাদের দৃষ্টিতে মহাঝামেলা। ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে, পাশ্চাত্যের সমাজে মানুষ আর মানুষ নেই, তারা হয়ে পড়েছে মানুষবেশী একেকটি রোবট। যতদিন কাজের সামর্থ আছে, ততদিন সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের মূল্য আছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে তারা কর্মহীন-অক্ষম হয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের জায়গা হয় ওল্ডহোম নামক যন্ত্রণার কারাগারে। অথচ ইসলাম বলছে, যখন তোমার বাবা-মা ওল্ডএজে চলে আসবে, তখন তাদের জন্য ভালোবাসার ডানা বিছিয়ে দাও। জীবনের শেষ দিনগুলোও যেন তারা হেসে খেলে অতিবাহিত করতে পারে। বিয়েহীন পাশ্চাত্য সমাজ এবং ইসলামী সমাজের মৌলিক পার্থক্য এখানেই।

 

দুনিয়া-আখেরাতে কল্যাণের চাবিকাঠি পরিবার

ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে শুধু দুনিয়ার কল্যাণ নয় আখেরাতের অফুরন্ত কল্যাণের চাবিকাঠিও। বিয়েকে ইসলাম ‘ধর্মের অর্ধেক’ বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামী সমাজের কোনো সদস্য যৌক্তিক কারণ ছাড়া বিয়ে থেকে বিরত থাকা নিন্দনীয়। এক হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বিয়ে হলো আমার সুন্নাত। যে আমার সুন্নাত পালন করবে সে যেন আমাকেই ভালোবাসলো। আর যে আমাকে ভালোবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’

বিয়ে মানুষের চোখ সংযত করে, লজ্জাস্থান হেফাজত করে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ রাখ, তারা যেন অতি দ্রুত বিয়ে করে ফেলে। বিয়ে চোখ সংযত রাখে, লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে। আর যার বিয়ে করার সামর্থ নেই সে যেন রোজা রেখে নিজের চাহিদাকে সংযত করে।’ মুসলিম।

বিয়ের মাধ্যমে দীনের অর্ধেক পূর্ণ হয়ে যায়। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি বিয়ে করে, তাহলে ধর্মের অর্ধেক দায়িত্ব পালন করা তার জন্য সহজ হয়ে গেল। সে যেন বাকি অর্ধেক দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন থাকে।’ মিশকাতুল মাসাবিহ বর্ণিত এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেন, মানুষ যত ধরনের গোনাহ করে তার অর্ধেক হলো যৌনতাকেন্দ্রিক গোনাহ। বিয়ে মানুষকে এসব গোনাহ থেকে দূরে রাখে। ফলে তার জন্য জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ হয়ে যায়।

 

হায়রে বৃদ্ধাশ্রম

যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ঝরনায় ছিল বাঙালি সিক্ত, সেখানে জমেছে যেন বিচ্ছিন্নতার গল্পহীন ধুলোর আস্তরণ। আবেগের পলেস্তরাগুলো ক্রমশ উঠে যেতে বসেছে। পড়ে আছে চুনকামহীন একান্নবর্তী পরিবারের সেই মর্মছোঁয়া বিমর্ষ অনুভূতি। নাগরিক জীবনে বহুকাল ধরে জীবন এখন একচিলতে বারান্দা, একরত্তি জানালা আর মুক্ত আকাশবিহীন আচ্ছাদনের ঘেরাটোপে আবৃত হয়ে আছে।

পারিবারিক বন্ধনের তাৎপর্য সম্পর্কে না জানার ফলে এখনকার সন্তানরা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনের একক পরিবার গড়ে তুলছে; বাদ যাচ্ছে না পরিবারের একমাত্র ছেলেটিও। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতেই আজ তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যার ফলশ্রুতিই বৃদ্ধাশ্রম।

পারিবারিক ভাঙনে যৌথ পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা। যার কারণে শেষ বয়সে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া প্রবীণদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত বিত্তশালী পরিবার থেকে আসা। এদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন। যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত। ফলে সম্মানের ভয়ে শেষ ভরসা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকেই বেছে নিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর