শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্রাচীন পুণ্ড্র রাজধানী বগুড়া

প্রাচীন পুণ্ড্র রাজধানী বগুড়া

বগুড়া, প্রাচীন ঐতিহ্য। এই প্রাচীন জনপদটি বহু ফকির ও সন্ন্যাসীর বিদ্রোহের ইতিহাস আর স্বাধীনতা যুদ্ধের সাক্ষী। প্রায় ১২৭৯ সালের প্রাচীন সুলতান নাসিরউদ্দীন বগরা খানের নামানুসারে বগুড়ার নামকরণ করা হয়। এটি প্রাচীন পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন আমলের বহু নিদর্শন পর্যটকদের কাছে এখনো ব্যাপক আকর্ষণীয় ও রহস্যঘেরা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। বগুড়া জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান আমাদের আজকের আয়োজন।

 

ঘুরে বেড়াই

রাজশাহী বিভাগের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বগুড়া। বগুড়াকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয়। ঢাকা থেকে প্রায় ২২৯ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী বগুড়া প্রায় ১২০০ শতাব্দীর পুরনো জনপদ। বর্তমান বগুড়া শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৮৫০ সালে, আর পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ১৮৮৪  সালে। ১২৭৯ সালে প্রাচীন সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবানের ২য় ছেলে সুলতান নাসিরউদ্দীন বগরা খানের নামানুসারে বগুড়ার নামকরণ হয়েছিল। পরে বহু ফকির ও সন্ন্যাসীর বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের হাজারো ইতিহাস নিয়ে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই বগুড়া।

♦  কীভাবে যাবেন : বগুড়া জেলায় যাতায়াতের জন্য বাস ও ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার জন্য বহু বাস সার্ভিস রয়েছে। তবে সবচেয়ে ভালো সার্ভিস পাবেন গ্রিন লাইন, টি আর ট্রাভেলস ও এস আর পরিবহনে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২৫০-৩৫০ টাকা। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে বগুড়াগামী বাস পেয়ে যাবেন। বগুড়া শহর থেকে অটোরিকশা কিংবা টেম্পোয় চড়ে পুরো শহরটি ঘুরে বেড়াতে পারবেন।

♦  কোথায় থাকবেন : বগুড়া শহরটি প্রাচীন ঐতিহ্য আর বর্তমান পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হওয়াতে এখানে অনেক ভালো মানের হোটেল-মোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে আপনি আধুনিক মানের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বগুড়া শহরের এসব হোটেলে একরাত কাটানোর জন্য প্রায় ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা গুনতে হবে। আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য অনেক ভালো হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানকার প্রায় সব হোটেলেই বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার পাবেন।

♦  দর্শনীয় স্থানসমূহ : বাংলার প্রাচীনতম শহর বগুড়ায় ঘুরে দেখার মতো অনেক প্রাচীর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে। এসব প্রাচীন স্থাপনার ইতিহাস অনেক পুরনো।

♦  মহাস্থানগড় : বগুড়ার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে মহাস্থানগড় হলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাচীন স্থান। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এক দুর্গ নগরী ছিল এই মহাস্থানগড়। এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি একসময় মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। বর্তমানে এখানে শুধু সেই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। মহাস্থানগড় বর্তমানে নীরবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মহাস্থানগড় খনন করে গুপ্ত, মৌর্য, সেন ও পাল বংশীয় যুগের দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়, যা এখনো জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত আছে। প্রায় ৫ হাজার ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪  হাজার ৫০০ ফুট প্রস্থের প্রাচীন নগরীর দেয়াল এখনো পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দেয়ালের ভিতরে রয়েছে জীয়ৎকুণ্ড, প্রাচীন মসজিদসহ নানা নিদর্শন।

♦  হজরত শাহ সুলতান বলখীর (রহ.) মাজার : মহাস্থান গড়ের আগেই দেখা মিলবে হজরত শাহ সুলতান বলখীর (রহ.)-এর বিখ্যাত মাজার। ১২০০ সালের দিকে এখানকার বাসিন্দাদের রাজা পরশুরামের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে  আফগানিস্তানের বলখ প্রদেশ থেকে আসা শাহ সুলতান বলখীর (রহ.) আগমন করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি নাকি মাছের পিঠে চড়ে এসেছিলেন। এ জন্যই তাকে মাহি সাওয়ার বলা হতো। প্রায় ১২০৫-১২২০ সালের সময়ে রাজা পরশুরামের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে রাজা পরশুরাম পরাজিত হন।

♦  গোকুল মেধ : বগুড়া শহরের ১০ কিলোমিটার উত্তরে ও মহাস্থানগড় থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দক্ষিণে গোকুল গ্রামে এ প্রাচীন প্রত্নস্থলটি অবস্থিত। অনেকের কাছে এটি বেহুলার বাসরঘর নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদদের মতে, আনুমানিক ৭-১২ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ইটের তৈরি স্তূপটি পূর্ব পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ এবং ত্রিকোণবিশিষ্ট। খননের পর এখানে ১৭২টি কক্ষ মিলে। 

♦  গোবিন্দ ভিটা : মহাস্থানগড় থেকে সামান্য উত্তরে করতোয়া নদীর কাছেই গোবিন্দ ভিটা অবস্থিত। এটি অনেক প্রাচীন একটি প্রত্নস্থল। ধারণা করা হয় এটি একটি প্রাচীন মন্দির। ১২০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত সংস্কৃতি গ্রন্থ ‘করতোয়া মহাত্ম’-তে মন্দিরটির ইতিহাস রচনা করা হয়। এখানে ১৯২৮-২৯ সালে সর্বপ্রথম, পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর বিভিন্ন যুগের নানা নিদর্শন পাওয়া যায়।

♦  মহাস্থানগড় জাদুঘর : মহাস্থানগড় থেকে সামান্য উত্তরে গোবিন্দ ভিটার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত জাদুঘরটি ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। প্রাচীন বগুড়ার অনেক দৃষ্টিনন্দন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনো রক্ষিত আছে জাদুঘরটিতে। জাদুঘরটি বেলা ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। প্রাচীন কালের  গুপ্ত, মৌর্য, সেন ও পাল বংশীয় দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে এখানে।

♦  শীলা দেবীর ঘাট : মহাস্থানগড়ের পূর্ব দিকে করতোয়া নদীর তীরে রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন শীলা দেবীর ঘাট। শীলা দেবী ছিলেন রাজা পরশুরামের ভগ্নি। যুদ্ধের সময় আত্মশুদ্ধির জন্য এখানে আত্মহত্যা করেছিলেন।

♦  ভাসুবিহার : বগুড়া শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জ উপজেলায় এ প্রাচীন প্রত্নস্থলটি অবস্থিত। যার আরেক নাম নরপতির ধাপ। খননের পরে এখানে অনেক প্রাচীন দুটি মধ্যম আকৃতির সংঘারাম ও একটি মন্দিরসহ অনেক প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। সবচেয়ে ছোট সংঘারামটির আয়তন ৪৯ মিটার। এর চার বাহুতে ভিক্ষুদের থাকার ২৬টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের সামনেই চারপাশ ঘোরানো বারান্দা ও পূর্ব বাহুর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রবেশদ্বার। বড় সংঘারামটিতে ৩০টি কক্ষ রয়েছে, যার দক্ষিণ বাহুর কেন্দ্রস্থলে প্রবেশপথ। বিভিন্ন সময়ে খনন করে এখানে প্রায় ৮০০টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে ব্রোঞ্জ নির্মিত ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ মূর্তি, রৌপ্য মুদ্রা, পোড়া মাটির ফলক, সিলমোহর, ধুপদানি, পিরিচ, মাটির পাত্র পাওয়া যায়।

এ ছাড়াও বগুড়াতে কালীদহ সাগর, বৌদ্ধবিহার, সাতমাথা ও বেহুলার বাসরসহ আরও অনেক প্রাচীন প্রত্নস্থল রয়েছে, যার প্রতিটিতে রয়েছে হাজার বছরের পুরো ঐতিহ্য। নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী ধারণা করা হয় এগুলো প্রায় ৭ম-৯ম শতকের পুরনো স্থাপনা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর