শিরোনাম
শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বয়স মানে না ফ্যাশন

বয়স মানে না ফ্যাশন

বিশেষ আয়োজনে প্রচ্ছদ হয়েছেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা শিক্ষাবিদ প্রফেসর শাহেদা ওবায়েদ ও অভিনেত্রী দিলারা জামান। শাহেদা ওবায়েদের ছবি মনজুরুল আলম এবং দিলারা জামানের ছবি : আইস টুডে

মানুষের রুচি ও পছন্দে বয়স কখনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যে কোনো বয়সেই একজন মানুষ নিজস্বতা ধারণ করে। দরকার শুধু সেই নিজস্বতাকে রুচিশীল করে উপস্থাপন করা। চলনে, কথনে এবং সাজসজ্জায় থাকে তার সর্বময় উপযুক্ততা। অনেকের ধারণা ফ্যাশন শুধু তারুণ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সে ধারণা বদলে যেতে বাধ্য শিক্ষাবিদ ড. শাহেদা ওবায়েদ ও বিশিষ্ট অভিনেত্রী দিলারা জামানকে দেখলে। লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

পাঁচ দশক ধরে সবার সামনে একই রূপে হাজির হওয়াটা মোটেও সহজ কাজ নয়। ফিটনেস ধরে রাখা, রুচিশীল পোশাক পরিধান, সাজগোজ, উপযুক্ত অনুষঙ্গের মেলবন্ধন ঘটানো আর তার মাঝে হাজারটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের বোঝা বহনের মতো বিষয় একসঙ্গে সামলেছেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. শাহেদা ওবায়েদ। ছাত্রছাত্রীর কাছে তিনি যেমন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন তেমনি ফ্যাশনে ছিলেন অনুকরণের কেন্দ্রবিন্দু। ম্যাডামের ভিন্নধর্মী চুলের স্টাইল, পোশাক পরিচ্ছদ, সাজগোজ সবই ছিল ছাত্রীদের কাছে এক বিস্ময়ের কারণ। দীর্ঘদিন পরেও কোনো ছাত্র প্রিয় শিক্ষিকাকে সাবেক রূপে দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে একটি প্রশ্নই করে বসেন— আমি, আমার আগের জেনারেশন, তার আগের জেনারেশন আপনাকে একইভাবে দেখছে। হয়তো আগামীতেও এমনি থাকবেন। এর গোপন রহস্য কী? হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর, ‘সৌন্দর্য নামক কোনো মোড়কে আবৃত নই, আমি কেবল আমার ভিতরের সৌন্দর্যেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকি। আর বাহ্যিক সৌন্দর্য তো ক্ষণস্থায়ী, সুন্দর মনের স্থায়িত্ব দীর্ঘ’। তার মতে, মানুষের মন সুন্দর হলে এমনিতেই সুন্দর থাকতে পারে। তাকে আর আলাদা কিছুই করতে হয় না। কিন্তু তাতেও কি নিজের ছাত্রছাত্রী, টিভি দর্শক ও ভক্তদের কাছে রহস্যের জট খোলে? সবার কাছে তিনি হয়ে আছেন রহস্যাবৃত সৌন্দর্যের অধিকারিণী। ড. শাহেদা ওবায়েদের ড্রয়িং রুমে কর্মজীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তোলা একাধিক ছবি সজ্জিত আছে। কালের সাক্ষী হয়ে থাকা প্রতিটি ছবিতেই তিনি যেন একই রূপে। চুলের পাফ করার ট্রেন্ড ছিল না, তখনো তার কপালের ওপর বিশেষ ভঙ্গিতে ঢেউ খেলে যাওয়ার স্টাইল মুগ্ধ করেছে সবার। সৌন্দর্যপ্রেমীরা ঢেউয়ের চোরাগলিতে হারিয়েছে বার বার। ব্যর্থ হয়ে ম্যাডামকে মেয়েরা জিজ্ঞেস করত, আপনি চুলকে কীভাবে সাজান? রাজনীতিবিদের স্ত্রী হওয়ায় পূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অঙ্গনকে সূক্ষ্মভাবে পাশ কাটিয়ে গেছেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছিল তার গৌরবময় পদার্পণ। দীর্ঘদিনের কর্মজীবনে প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে উজ্জ্বল কর্মদক্ষতার ছাপ। একসঙ্গে এত এত কাজ করার পরেও নিজেকে একইভাবে উপস্থাপন করে এসেছেন তিনি। কিন্তু কীভাবে? হাসি কান্না, ব্যস্ততা, অবসর মিলিয়েই মানুষের জীবন। সবকিছুর মাঝেও কেউ যেন আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ না পান, আমি কিছুটা বিব্রত আছি কিনা। তা ছাড়া সারাজীবনে কাজের সূত্রে পরিচিতদের কাছে চেনা শাহেদা ওবায়েদকেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, আমার এই লুকই একটি স্বাতন্ত্র্য পরিচয় বহন করে। সেজন্য সময়কে সেভাবে সেট করে নিয়েছিলাম, যাতে নিজেকে একইভাবে প্রতিদিন প্রস্তুত করতে পারি।

জানা গেল, তিনি কখনই পার্লারে যান না। সাজগোজের পুরোটাই নিজে করেন। পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ রং কে প্রাধান্য দেননি। তবে রুচির বিষয়কে মাথায় রেখে রং আর ডিজাইনে অভিনত্ব রেখেছেন সব সময়। কোথায় যাচ্ছেন, সেখানে তার ইমেজ কেমন, কী উপলক্ষে যাচ্ছেন, সবকিছুকে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজেকে প্রস্তুত করার ব্যাপারে। খাবার দাবারের ব্যাপারে তিনি আগাগোড়ায় সচেতন। নিয়মিত জিম করেননি তবুও ফিটনেস ধরে রেখেছেন কীভাবে? খাদ্যাভাস আর কাজের ব্যস্ততা মিলে আমাকে ঠিক রাখতে সাহায্য করেছে। অবসরে যাওয়ার পর খাবারের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হই। ত্বকের চর্চায় পছন্দের অল্পকিছু কসমেটিক্স ব্যবহার করেন। পোশাক বাছাইয়ে তার পছন্দ শাড়ি। পরার আগেই কুঁচি করে পিনআপ করে নেন। তাই শাড়ি পরাটা হয় ঝটপট। ঘোরাঘুরি করার সময় থ্রিপিস বা আরামদায়ক কোনো পোশাককে বেশি প্রাধান্য দেন। জানালেন, কেনাকাটার ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সচেতন। তবে অর্নামেন্টসগুলো সব সময় পছন্দ ও মাপ অনুযায়ী হয় না। তাই বাসায় এসে নিজস্ব কারিকুরিতে পছন্দমতো করে ফেলি। অবসর সময়ে বই পড়া, গান শোনা, সামাজিক মাধ্যমে ব্যস্ত থাকা, আত্মীয় পরিজনের খোঁজ নিতেই কেটে যায়। বছর সাতেক আগে প্রায় সব ব্যস্ততাকে বিদায় জানিয়ে মোটামুটি এখন তিনি একাই থাকেন ৩ হাজার বর্গফুটের একটি বাসায়। মাঝে মাঝে টেলিভিশন বা কোথাও প্রোগ্রাম থাকলে কিছুটা ব্যস্ত সময় কাটে।

 

সাজসজ্জা, আনন্দ-বিনোদন, জীবনযাত্রায় মানুষের বয়স বাধা হয়ে থাকে না। প্রায় পঁচাত্তরে এসেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী গুণী অভিনেত্রী দিলারা জামান তারই প্রমাণ। ‘বাঙালিয়ানা রীতি আমার সবচেয়ে পছন্দ। আর সে কারণে পোশাক হিসেবে সব সময় বেছে নিয়েছি পছন্দের যে কোনো শাড়ি, সঙ্গে থেকেছে সাদামাটা সাজ।’ ১৯৫৭ সাল থেকে পোশাক হিসেবে তিনি একটানা শাড়িই পরছেন। তবে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নজরকাড়া রং আর কারুকাজময় পোশাকটিই তিনি বেছে নেন। দর্শকরা তাকে আগাগোড়া আদর্শবান চরিত্রে দেখে অভ্যস্ত। নিজেও ধারণ করেন তার পুরোপুরি। সেই ভাবকে অক্ষুণ্ন রেখে সাজের মাঝে জাঁকজমকভাব ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করেন উপযুক্ত অনুষঙ্গ। বয়সের কারণে নানা ধরনের রোগ থাকলেও নিজেকে সুস্থ রাখতে মেনে চলেন সঠিক খাদ্যাভাস। তার কাছে সুস্থ থাকাটা পৃথিবীতে সবচেয়ে আনন্দের। এই বয়সেও তিনি স্মার্টনেসের সঙ্গে নিজের সব কাজ একাই করে চলেছেন। শুটিংয়ে যাওয়া, বাজার করা, রান্না করা, ঘর গোছানো সবই তাকে একা করতে হয়। কেনাকাটা করার সময় চলার সুবিধার্থে বেছে নেন সালোয়ার কামিজ। বিদেশি পোশাকের প্রতি তার কোনো ক্ষোভ নেই। দিলারা জামানের কাছে শালীনতার সঙ্গে পোশাক পরাটা বেশি গুরুত্ব পায়। সেজন্য তার কাছে দেশি পোশাকই অগ্রগণ্য।

 

গৌরবময় কর্মজীবন

প্রফেসর ড. শাহেদা ওবায়েদ কর্মজীবন শুরু করেন ১ মার্চ ১৯৭১ সালে। ৩১ জানুয়ারি ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন সরকারি কলেজে চাকরি করেছেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য স্বেচ্ছাসেবী ভূমিকা। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকার অধ্যক্ষ ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কম্পিউটার সেন্টারের প্রধান, ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ডিরেক্টর জেনারেল, ২০০৫ সালে ইউআইটিএস এর ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা এবং ২০০৬ সালে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. শাহেদা ওবায়েদ সবচেয়ে বেশি পরিচিত একজন দক্ষ শিক্ষক হিসেবে। প্রফেসর শাহেদা ওবায়েদ জাতীয় শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা ও সার্টিফিকেট অথরিটির সদস্য ছিলেন। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রজেক্টেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য। এ ছাড়াও ২০০৪ সাল থেকে দেশের ছেলেমেয়েরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলাফল লাভ শুরু করছে তার উদ্যোগে। শিক্ষাদানের পাশাপাশি মিডিয়ার প্রতি তার আগ্রহ ও ভালোলাগা ছিল অসীম। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের টিভি প্রোগ্রামের উপস্থাপনা ও টকশোতে দেখা যায় প্রিয় এই মুখ। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ড ও সেন্সর বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কলাম লেখা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে তার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। একাধিক অঙ্গনে দক্ষতার সঙ্গে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সরকারি বেসরকারি অসংখ্য পুরস্কার। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে তিনি জাতিসংঘে যোগদান করেন। তার অপর পরিচয় হলো, জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, বিএনপির সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের স্ত্রী।

 

বাংলাদেশি নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী দিলারা জামানের অভিনয়ের শুরু ১৯৬৬ সালে ত্রিধরা নাটক দিয়ে। অসংখ্য নাটকসহ তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। ১৯৯৩ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হন। অন্য আরও পুরস্কারের সঙ্গে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও আছে এই গুণী অভিনেত্রীর ঝুলিতে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর