শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

HBs Ag ও জন্ডিস

বিলিরুবিন এক ধরনের হলুদ জাতীয় পদার্থ যার আধিক্যে সারা শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বিশেষ করে চোখ, হাত-পায়ের তালুতে এই হলুদ বর্ণ প্রাথমিক অবস্থাতে পরিলক্ষিত হয় এবং প্রস্রাব গাঢ় বর্ণ ধারণ করে।

HBs Ag ও জন্ডিস

জন্ডিস সচরাচর পরিলক্ষিত এক ধরনের অসুস্থতা যাতে অধিকাংশ মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। লিভার বা যকৃত অথবা কলিজার প্রদাহ বা মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হলে রক্তে (Billirubbin) বিলিরুবিন নামক এক ধরনের পদার্থের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি ঘটে থাকে। বিলিরুবিন হলুদ জাতীয় পদার্থ যার আধিক্যের জন্য সারা শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করে বিশেষ করে চোখ, হাত-পায়ের তালুতে এই হলুদ বর্ণ প্রাথমিক অবস্থাতে পরিলক্ষিত হয় এবং প্রস্রাব গাঢ় বর্ণ ধারণ করে থাকে।

 

ভাইরাসের দ্বারা লিভার আক্রান্ত হলে, পিত্ত থলিতে অথবা পিত্তনালিতে পাথর থাকলে প্রদাহ সৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। আরও যে সব কারণে জন্ডিস হয়ে থাকে তা হলো লিভার বা পিত্তনালিতে টিউমার বা ক্যান্সার জাতীয় অসুস্থতা, পিত্তনালি

কৃমির দ্বারা বন্ধ হয়ে যাওয়া, পেনক্রিয়াস নামক গ্রন্থিতে ক্যান্সার জাতীয় অসুস্থতা, পিত্তথলির বা পিত্তনালির অপারেশনের জটিলতা ইত্যাদি। ভাইরাল ইনফেকশনের ফলে লিভারের প্রদাহ সৃষ্টির মাধ্যমে জন্ডিস হওয়ার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অনেক ধরনের ভাইরাস লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে থাকে।

 

হেপাটাইটিস (লিভারের প্রদাহ) ভাইরাসই জন্ডিসের জন্য মূলত দায়ী তবে অন্যান্য অনেক ভাইরাস হালকা ধরনের জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে। এ পর্যন্ত ৫ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে যাদের A, B, C, D এবং E এভাবে নামকরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে হেপাটাইটিস A ভাইরাস ও হেপাটাইটিস E ভাইরাস পানি বা খাদ্যের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে অসুস্থতার সৃষ্টি করে থাকে। অন্য ৩টি হেপাটাইটিস ভাইরাস যেমন B, C ও D ভাইরাস রক্তের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে থাকে। সাধারণভাবে ইনজেকশন দেওয়ার সময় অন্যের শরীরে ব্যবহৃত সুই ব্যবহার করলে, কারও রক্তে ভাইরাস আছে এমন ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে, কারও রক্ত জখমে লেগে গেলে। অন্যের ব্যবহৃত রেজার বা টুথব্রাশ ও দাঁত পরিষ্কার করার যন্ত্র ব্যবহার করলে। ট্যাটু বা উল্কি করার সুইয়ের মাধ্যমে। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সঙ্গম করলে, ঝগড়া ফ্যাসাদের সময় কাউকে কামড়ে দিলে। আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে গর্ভজাত সন্তান এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মারাত্মক এইডস ভাইরাসও ঠিক একই পদ্ধতিতে ছড়িয়ে থাকে।

 

হেপাটাইটিস A ও E ভাইরাস স্বাভাবিকভাবে শিশু কালেই বেশি হয়ে থাকে। A ভাইরাস সাধারণ ধরনের জন্ডিস করে থাকে যা অল্প সময়ের মধ্যে রোগী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হয়ে যায়। তবে E ভাইরাস গঠিত জন্ডিস অনেক সময়ই মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং প্রায়ই জন্ডিস দীর্ঘ সময় বিদ্যমান থাকে। অনেক সময়ই E ভাইরাস জটিল আকার ধারণ করে বিশেষ করে  প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের বেলায়। কারও কারও প্রদাহের ফলে লিভার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। রক্তের মাধ্যমে প্রবেশকারী ৩টি ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে B ভাইরাস দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। B ভাইরাস ছাড়া D ভাইরাস একাকী বাঁচতে পারে না। তাই D ভাইরাস একাকী শরীরে প্রবেশ করতে পারে না এবং লিভারকে আক্রান্ত করতে পারে না। C ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম তাই B ভাইরাসের আক্রমণকে প্রধানত বিবেচনায় আনা হয়।

 

কারও দেহে একবার Hepatitis B virus (হেপাটাইটিস বি, ভাইরাস) প্রবেশ করলে অনেকদিন সুপ্ত অবস্থায় বিরাজমান থাকে। সুপ্তকালীন সময়ে এ অবস্থায় রোগের কোনোরূপ লক্ষণ ব্যক্তি দেহে পরিলক্ষিত হয় না কিন্তু ভাইরাস দেহে আক্রমণের ফলে দেহকোষ এক ধরনের এন্টিবডি নামক পদার্থ রক্তে নিঃসৃত করে থাকে। যাকে HBs Ag নামে অভিহিত করা হয়। যা শুধু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ণয় করা সম্ভব। যদি কারও HBs Ag পজেটিভ হয় তবে ধরে নেওয়া হয় উক্ত ব্যক্তি হেপাটাইটিস B ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এবং তিনি রক্তের মাধ্যমে B ভাইরাস দ্বারা অন্যকে আক্রান্ত করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। দেহে B ভাইরাস একবার প্রবেশ করলে প্রাথমিক অবস্থায় সুপ্ত থাকে বটে, তবে সুযোগ বুঝে যে কোনো সময় রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে রোগ সৃষ্টির আগে ৬ মাস থেকে বহু বছর পর্যন্ত ই ভাইরাস সুপ্ত থাকতে পারে। সাধারণত এই ভাইরাসের রোগ সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ ৩ ভাবে হতে পারে।

এক- জন্ডিস রোগ সৃষ্টি করতে পারে যা কিনা খুবই মারাত্মক হতে পারে। লিভার ধ্বংস হয়ে  রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

দুই- হেপাটাইটিস বা জন্ডিস আক্রমণ হওয়ার ফলে বার বার অল্প অল্প করে লিভার নষ্ট করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যাকে লিভার সিরোসিস বলা হয়। লিভার সিরোসিসও খুবই জটিল ব্যাধি, যার তেমন সুচিকিৎসা নেই। উপরে উল্লিখিত উভয় অবস্থায় লিভার প্রতিস্থাপন করে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা যেতে পারে। তবে লিভার প্রতিস্থাপন বেশ ব্যয়বহুল এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

তিন- উপরে উল্লিখিত দুই অবস্থার জটিলতা হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তি লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যার তেমন কোনো সুচিকিৎসা নেই বললেই চলে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে থাকে।

 

রোগের লক্ষণ পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগী বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভুগতে পারেন। শরীর ব্যথা, খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে তবে সবার এ ধরনের লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তারপর জন্ডিসের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। জন্ডিসে প্রাথমিক অবস্থায় প্রস্রাব গাঢ় বর্ণ ধারণ করে হাত-পায়ের তালু হলুদ বর্ণ ধারণ করা, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। তার সঙ্গে লিভার বড় হওয়ার জন্য পেটের উপরের অংশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। কারও কারও শরীরে প্রচ- চুলকানি হতে পারে। কী ধরনের ভাইরাস দ্বারা ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন তার ওপর নির্ভর করবে যে জন্ডিস কতদিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। জন্ডিস যত বেশি সময় বিদ্যমান থাকবে রোগীর অবস্থা জটিল হওয়ার সম্ভাবনাও ততই বেশি। মারাত্মক অবস্থায় রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

 

প্রতিরোধের উপায় : বাইরের খাবার ও পানি পানে সতর্ক থাকতে হবে কারণ এ সবের মাধ্যমে A ও  E ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। রক্ত গ্রহণ করা, ইনজেকশন নেওয়া, অন্যের রেজার, টুথব্রাশ ব্যবহার করা, অন্যের শারীরিক জখম ও রক্ত ছোঁয়ার আগে নিশ্চিত হওয়া যে আপনার হাতে কোথাও কোনো ক্ষত নেই। অবৈধ যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা। B ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই বিশেষ করে শিশু কালেই B ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে টিকা গ্রহণের পূর্বে দেহে B ভাইরাসের আক্রমণ ঘটে নাই তা নিশ্চিত হওয়া। কারণ একবার B ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গেলে টিকা গ্রহণ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে কেউ B  ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন কিনা। রক্তে HBs Ag পজেটিভ থাকলে আপনি B ভাইরাস দ্বারা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়ে গেছেন কাজেই আপনার টিকা নিয়ে কোনো লাভ হবে না তবে যদি আপনার রক্তের পরীক্ষায় HBs Ag নেগেটিভ হয় তবে আপনি B ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি এবং  আপনি টিকা গ্রহণ করে B ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।

 

চিকিৎসা : বর্তমানে বেশ কিছু ফলপ্রসূ এনটি-ভাইরাল ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। যার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস B দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিগণ (HBs Ag পজেটিভ) এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তবে একমাত্র অভিজ্ঞ চিকিৎসকই আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। তবে কু-চিকিৎসা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কারণ তাতে আপনার ভালোর চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

 

লেখক-

ডা. এম. শমশের আলী

সিনিয়র কনসালট্যান্ট (প্রা.),

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর