অসংক্রামক; এক নীরব ব্যাধি। এ ব্যাধি ধনী দেশে বসবাসকারী বয়স্কদের হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে এ রোগে আক্রান্তদের অর্ধেকই কম বয়সী এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ হচ্ছে।
সারা বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি নীরব ঘাতকের মতো ধেয়ে আসছে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হামের মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় হচ্ছে এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকরী টিকা কর্মসূচি, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংক্রামক ব্যাধি কমছে এবং মানুষের গড় আয়ুও বেড়ে চলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বয়সজনিত কারণে বার্ধক্যজনিত রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থাইসিস, উচ্চ-রক্তচাপ, ক্যান্সার ও মানসিক রোগসহ অসংক্রামক রোগের প্রকোপ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব ও চাপ পড়তে শুরু হয়েছে। পূর্বে ধারণা করা হতো, অসংক্রামক ব্যাধি শুধু ধনী দেশে বসবাসকারীদের এবং বয়স্ক লোকের হয়। প্রকৃতপক্ষে এ রোগে আক্রান্তদের অর্ধেক কম বয়সী এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ :
মানুষের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অস্থিরতা, খাদ্যাভ্যাস, যান্ত্রিক জীবন সবকিছু মিলিয়েই অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর্থিক অসচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে। আরও কিছু কিছু কারণ যেমনÑ
* কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম না করা।
* অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া।
* ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা, মাদকসেবন।
* অতিরিক্ত টেনশন, মানসিকচাপ।
* খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শাক-সবজি, ফল-মূল কম খাওয়া, অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমলপানীয় গ্রহণ।
* খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা বা খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ, টেলিভিশন আর কম্পিউটার গেম ও ফেসবুক।
* গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা।
* খাদ্যে কেমিক্যাল ও ভেজাল।
* জলবায়ু দূষণ।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে :
এসব রোগ চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় বহুল এবং অনিরাময়যোগ্য হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
* আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।
* কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বাড়তি ওজন কমাতে হবে।
* ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে পুরোপুরি বিরত থাকতে হবে।
* খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কম চর্বি ও কম কলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। লবণ নিয়ন্ত্রণের জন্য তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
* শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
* মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, নিজের শখের কাজ করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।
অসংক্রামক রোগ আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যতœবান হতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু একবার আক্রান্ত হলে এ ধরনের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, তাই সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধেরা বিকল্প নেই।
লেখক-
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
চেয়ারম্যান (প্রা.), মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।