শনিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

পোড়া রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি এত বেশি কেন

ডা. মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী

পোড়া রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি এত বেশি কেন

ত্বক বা চামড়ার কারণে পরিবেশের অতিক্ষুদ্র ক্ষতিকারক রোগজীবাণু, ধূলিকণা, রেডিয়েশন ইত্যাদি শরীরের ভিতরে ঢুকতে পারে না। ত্বকের কারণে প্রতিকূল অবস্থায়ও মানবদেহের অভ্যন্তরীণ সব জৈবিক-রাসায়নিক ও বিপাক প্রক্রিয়া প্রায় অক্ষুণ্ন থাকে ও স্বাভাবিক তাপমাত্রা ঠিক রাখে। যখন এই ত্বক বা শ্বাসনালির মিউকাস মেমব্রেন পুড়ে যায় তখন দেহের সব প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক জৈবিক ও রাসায়নিক-বিপাক প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় গ্রন্থি যেমন লিভার, কিডনি- এমনকি সব দেহকোষের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে বার্ন স্ট্রিচ শরীরের সব রাসায়নিক উত্তেজক গ্রন্থির সিক্রেশন আরও দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যায় এবং অতি অল্প সময়ে ওই পোড়া রোগীর সব শরীর ফুলে ফেঁপে যায়। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইডিমা (Oedema) ফরমেশন বলে।  

ইডিমার কারণে বাতাসের মধ্যে থাকা অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহকোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছতে পারে না বিধায় পোড়া রোগী চিকিৎসায় ভালো বা আবার মন্দও হতে পারে। তারপরও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে Smoke inhalation injury সর্বদাই শ্বাসনালির চরম ক্ষতির কারণ নয়, রোগীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং পরিমাপ করতে হবে ওই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মুখ, মুখগহ্বরের উপর-নিচ ও শ্বাসনালি কতটুকু ফুলে ফেঁপে গেছে, ধোঁয়ার তীব্রতা কেমন ছিল, কি পরিমাণ গরম ছিল, তা কতক্ষণ যাবৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বার্ন করেছে, ঢোক গিলতে কতটুকু কষ্ট, নাকের লোম, এ সবই অভিজ্ঞ নিবিড় পরিচর্যাকারীরাই পরখ করতে পারেন। তবে Fiberoptic Nasopharyngoscopy করে উপরোক্ত শ্বাসনালির গতিপথ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। অহেতুক বা অনভিজ্ঞতার কারণে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর জন্য শ্বাসনালিতে টিউব দিলে শ্বাসনালির অত্যন্ত ঢেলিকেট মিউকাস মেমব্রেন, ভোকাল কর্ড, এ্যাপিগ্লো স্টিক, সাবগ্লোস্টিক, সুপ-রাগ্লোস্টিক ইত্যাদি জায়গায় আঘাতজনিত কারণে আরও বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। একে মেডিকেল সাইন্সে ইনটুবেশন ইনডিউস্ট ইনজুরি বা ভেনটিলেটর ইনডিউস্ট ইনজুরি ও টার্মিনাল ইনডিউস্ট ইনজুরি বলা হয়। তাই পর্যাপ্ত কৃত্রিম শ্বাস প্রদানের প্রয়োজনীয় প্রমাণ ছাড়া শ্বাসনালিতে টিউব দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। শুধু অভিজ্ঞ পরিচর্যাকারী গভীর পর্যবেক্ষণ করে যদি বুঝতে পারেন, ওই শ্বাসনালি পোড়া রোগীর উলি্লখিত লক্ষণসমূহ আছে এবং যদি Fiberoptic Nasopharyngoscopyy করে দেখতে পারেন যে শ্বাসনালির গতিপথ গাঠনিক বিকৃত পরিবর্তন হয়ে রোগী রেসপাইরেটরি ফেইলুরের দিকে যাচ্ছে। কেবল তখনই শ্বাসনালিতে টিউব দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের যান্ত্রিক সাপোর্ট দেওয়ার বিধান আছে।  

প্রফেসর ডেমলিং এবং প্রফেসর চেন শ্বাসনালি পোড়া রোগীর মৃত্যুর বৈজ্ঞানিক রহস্য নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন- তারা বলেছেন শ্বাসনালি পোড়া রোগীর প্রথমত শ্বাসনালির গতিপথে অতিরিক্ত রক্তরস জমা হতে থাকে, একে বলে পালমোনারি কনজেশন। তারপর পালমোনারি হাইপারটেনশন, পরবর্তীতে শ্বাসনালির সব গতিপথ সরু হয়ে যায়, এই গতিপথে ধীরে ধীরে ইপিথেলিয়াল স্লাফ, ইপিথেরিয়াল কাস্টস জমা হয়, ফলে শ্বাসনালির সিলিয়ারি মোভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয় এবং শ্বাসনালির গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তখন শ্বাসনালির ভিতরের অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা বের হতে পারে না বিধায় জীবনরক্ষাকারী অক্সিজেন ফুসফুসে গিয়েও এক্সচেঞ্জ হতে পারে না। এই অবস্থায় রোগীর শ্বাসনালির চারপাশের ক্ষতিকারক জীবাণু শ্বাসনালিকে সংক্রমিত করে ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়ে।  

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, (এ্যানেসথেসিয়া), বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর