মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরা

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরা

'বোবায় ধরা' কথাটা শুনতে একটু অদ্ভুতই লাগে। তবে কম-বেশি সবাই এর সঙ্গে পরিচিত। কেউ কেউ এটাকে ভৌতিক বলেও বিশ্বাস করে থাকেন। তাই জেনে নেওয়া যাক 'বোবা ধরা'র আদ্যোপান্ত। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অনুভব করলেন, আপনার বুকের ওপর ভারী কিছু বসে আছে। এত ভারী কিছু যে দমটা বন্ধ হয়ে আসছে, ভালোভাবে নিঃশ্বাসই নিতে পারছেন না। কেমন লাগবে তখন? নিশ্চয়ই খুব ভয় পাবেন! এটা একটা ভীতিকর পরিস্থিতিই বটে। আবার যখন টের পাবেন, তখন আপনি চাইলেও শরীরের কোনো অংশ নাড়াতে পারছেন না, এমনকি চিৎকারও করতে পারছেন না। নিজেকে এমন অসহায়ভাবে আবিষ্কার করলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। আসলে ‘বোবায় ধরা’ শব্দটি এসেছে লোকাচারীয় কুসংস্কার হতে। অনেকের ধারণা, বোবা নামের ভূত ঘুমের মধ্যে বুকে বসে নাক-মুখ চেপে ধরে, ফলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে এবং চোখ খুলেও আক্রান্ত মানুষটি কথা বলতে পারে না। অনেকে এমনও বলেন ভূতটিকে ধাক্কা দিলেও সরানো যায় না। একেই তাঁরা ‘বোবায় ধরা’ বলে থাকেন। তবে এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নয়। বোবা ধরার বাংলা পরিভাষা হলো ‘নিদ্রা পক্ষাঘাত’, ইংরেজিতে ‘স্লিপ প্যারালাইসিস’। বোবায় ধরলে ব্যক্তি যেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে অতি-অল্প সময়ের জন্য বাক ও চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন, নড়াচড়াও করতে পারেন না, সেহেতু এটিকে ঘুমের পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস বলা হয়। বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস স্রেফ একটা ইন্দ্রিয়ঘটিত, মানসিক ব্যাপার। যখন শরীর গভীর ঘুমের এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে যায়, তখনই এটা ঘটে থাকে। বোবা ধরলে একেকজনের একেক রকম অভিজ্ঞতা হয়। কেউ ঘরের ভিতর ভৌতিক কিছুর উপস্থিতি টের পান, কেউ দুর্গন্ধ পান, কেউ বা ভয়ানক কোনো প্রাণী দেখতে পান। মোটকথা তখন একটা হ্যালুসিনেশনের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। গভীর ঘুমের এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে যাওয়ার সময় মস্তিষ্ক সতর্ক হয়ে ঘুম ভেঙে গেলেও শরীর আসলে তখন ঘুমেই থাকে। ফলে অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম হয়। বিশেষ করে ইন্দ্রিয় তখন আচ্ছন্ন থাকায় মানুষ অদ্ভুত কিছু দেখে এবং শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। সাধারণত যাদের ঘুমের সমস্যা থাকে তারাই বেশি স্লিপ প্যারালাইসিসে ভোগেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, অতিলৌকিক কোনো কিছু এ ব্যাপারটি ঘটায়। আসলে এটা স্রেফ একটি শরীরবৃত্তীয় ব্যাপার। অন্য কিছু নয়।

কেন এমন হয় : বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো চাপের মধ্যে থাকা এবং যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রামের অভাব। ঘুমের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে যাওয়ার সময় শরীর সাবলীলভাবে নড়াচড়া করতে পারে না, তখনই মানুষ বোবা ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়।

ঘুমের নির্দিষ্টতা না থাকা, সময়মতো না ঘুমানো বা কম ঘুমানো, অনিয়মিত ঘুম, উপুড় হয়ে ঘুমানো বা ঘুমের সময় পরিবর্তন।  নার্কোলেপ্সি বা অতি ঘুমকাতরতা, ঘুমের মধ্যে হাত পা ছোঁড়া বা হাঁটা, অন্যান্য নিদ্রাজনিত রোগ থাকা যেমন হাত পায়ের মাংসপেশিতে খিঁচ ধরা। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, বিষণœতা, বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা এ জাতীয় মানসিক সমস্যা।

পরিত্রাণের উপায় : বোবায় ধরা আসলে গুরুতর কোনো রোগ নয়, তেমন কোনো চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। তবে তা যদি ঘন ঘন হতে থাকে বা ঘুমে নিয়মিতভাবে ব্যাঘাত ঘটায় বা উদ্বিগ্নতার দরুণ রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বা কমে যায়, তখন এই বোবায় ধরা থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা মানতে হবে।

কিছু টিপস : বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস থেকে বাচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সহজ উপায় হলো ঘুমের নির্দিষ্ট সময় মেনে চলা। নিয়মিত কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ঘুমের সময় চিত কিংবা উপুড় হয়ে না শুয়ে কাত হয়ে শোওয়া উত্তম। ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা আগে খাবার গ্রহণ করতে হবে। যারা অধিক মাত্রায় দুশ্চিন্তা বা বিষন্নতায় ভোগেন, তাদের উচিৎ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী চলতে হবে। তাই এসব বিষয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

লেখক : সাবেক ডিন, মেডিসিন অনুষদ,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর