শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডেঙ্গুর টাইপিং বের করাটাও জরুরি

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

ডেঙ্গুর টাইপিং বের করাটাও জরুরি

এডিস ইজিপটি নামের মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে। এই মশা ভাইরাসবাহী কাউকে কামড়ানোর পর অন্য আরেকজনকে কামড়ালে সেই মানুষটি আক্রান্ত হয়। এডিস মশা স্থির পানিতে, যেমন- পরিত্যক্ত টায়ার, পানির বোতল, কনটেইনার, ফুলের টব, এয়ারকুলারের পানি ইত্যাদির মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে। সাধারণত শহরাঞ্চলে রোগটি বেশি হয়, তুলনামূলকভাবে গ্রামে কম হয়। এক রোগী থেকে অন্য মানুষের শরীরে সরাসরি ডেঙ্গু ছড়াতে পারে না। তাই রোগীর সংস্পর্শে গেলেই ডেঙ্গুও হয় না।

চারটি সেরোটাইপ : ডেঙ্গুর বিষয়টি মানুষ জানলেও এর যে গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন হচ্ছে, সে সম্পর্কে সচেতনতা নেই অনেকের। অনেক চিকিৎসকেরও এ বিষয়ে ভালো ধারণা নেই। এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। ডেঙ্গু রোগের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪)। সাধারণত একবার এক সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময় আরেকটি দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারও হয়তো ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কোনো টাইপের ডেঙ্গু তা শনাক্ত করা হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি টাইপিং বের করাটাও জরুরি। না হলে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

রকমফের : ভাইরাসজনিত জ্বর ডেঙ্গু, যা এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম-এই কয়েক ধরনের ডেঙ্গু হয়।

ক্লাসিক্যাল : ক্লাসিক্যাল বা সাধারণ ডেঙ্গুতে প্রচ- জ্বর হয়, যা ১০৪ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্তও হতে পারে। জ্বর দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। সঙ্গে মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশি বা গিঁটে ব্যথা, শরীরে র‌্যাশ থাকতে পারে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু হলে তেমন সমস্যা নেই, এতে মৃত্যুর মতো ঘটনা সাধারণত ঘটে না।

হেমোরেজিক : ডেঙ্গু হেমোরেজিকে জ্বর কমে যাওয়ার দু-তিন দিনের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল লাল র‌্যাশ বা রক্তবিন্দুর মতো দাগ দেখা যায়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাড়ি বা নাক দিয়ে আপনা-আপনি রক্তক্ষরণ, রক্তবমি, কালো রঙের পায়খানা, ফুসফুসে বা পেটে পানি জমা ইত্যাদি। রক্ত পরীক্ষা করালে দেখা যায়, রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি, যাতে শরীর থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে।

শক সিনড্রোম : ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের উপসর্গগুলোর পাশাপাশি রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ কমে, নাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়, হাত-পা শীতল হয়, রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের জ্বর হলে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। অনেক সময় চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত বা অণুচক্রিকাও দিতে হতে পারে। তবে সবার যে এমন হবে, তা কিন্তু নয়।

জ্বর হলে করণীয় : যে কোনো জ্বরে আক্রান্ত রোগী যত বেশি বিশ্রামে থাকবে, যত বেশি তরল খাবার খাবে, তত দ্রুত জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই ডেঙ্গুর মূল চিকিৎসা প্রচুর তরল বা পানি গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকা ইত্যাদি। যে কোনো জ্বরে ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর তাপমাত্রা গেলেই তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সাপোজিটরি ব্যবহার করতে হবে। প্রচুর পানি, শরবত ও তরল খাবার বেশি দিতে হবে। কোনো অবস্থায়ই শরীরে যেন তরলের ঘাটতি না হয়। জ্বর হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাবেন না। অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ না করাই উচিত। তবে যে কোনো জ্বর তিন দিনের বেশি থাকলে, শরীরে প্রচ- ব্যথা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এতে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ সেবন নয়। কেননা হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে কিছু ব্যথার ওষুধ রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে বিপদ ঘটাতে পারে। তীব্র জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু কোনো মারাত্মক রোগ নয় এবং এতে চিন্তার কিছু নেই। এই রোগ নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়, এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে মারাত্মক জটিলতা এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত। জ্বর কমে যাওয়ার পরের কিছুদিনকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। এ সময়টায় সবার সচেতন থাকা খুব জরুরি। ডেঙ্গু নিয়ে অহেতুক ভয় নেই। সাধারণ ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি এক শতাংশের কম।

কখন হাসপাতালে : ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাড়িতেও সম্ভব, তবে বেশি দুর্বল ও পানিশূন্য হয়ে পড়লে বা শরীরের কোথাও রক্তবিন্দুর মতো দাগ, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার মতো যে কোনো লক্ষণে দেরি না করে হাসপাতালে নিতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের কারও পেট ব্যথা বা ডায়রিয়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাই সঙ্গে সঙ্গেই তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

মায়োকার্ডিটিসে ভয় বেশি : এখনকার ডেঙ্গুর প্রকৃতি ও ধরন অনেকটা বদলে গেছে। ডেঙ্গু হলে অনেকের হার্ট, লিভার ও কিডনি আক্রান্ত হচ্ছে। নতুন আতঙ্ক হয়ে সামনে এসেছে মায়োকার্ডিটিস বা হৃদযন্ত্রের প্রদাহ। ডেঙ্গু হলে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না নিলে হৃৎপিন্ডের পেশির প্রদাহ বা মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। ডেঙ্গুর কারণে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হওয়া খুবই বিপজ্জনক। এটি প্রায়ই ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হলেও অনেক চিকিৎসকের পক্ষে তা দ্রুত বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।

মায়োকার্ডিটিসের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো-শ্বাস-প্রশ্বাসের হ্রস্বতা, বুকের ব্যথা, ব্যায়াম করার ক্ষমতা হ্রাস, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ইত্যাদি। এই রোগ নির্ণয়ে রক্ত পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে, ইলেকট্রোক্রেডিওগ্রাফি (ইসিজি), ইকোকার্ডিওগ্রাম (হৃদযন্ত্রের বিশেষ আল্ট্রাসাউন্ড) ইত্যাদি পরীক্ষা করা যেতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয় : ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ হলেও এর কার্যকর কোনো টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই রোগটি প্রতিরোধ করতে হলে যে কোনোভাবেই হোক, নিজেকে মশার কামড়ের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। স্ত্রী এডিস মশা সাধারণত অল্প পানিতে, যেমন ঘরের ভিতরে জমে থাকা পানি, টবের পানি, ফ্রিজের পিছনে জমে থাকা পানি ইত্যাদিতে ডিম পাড়ে। তাই ফুলের টবসহ বাসার বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা স্বচ্ছ পানি নিয়মিত অপসারণ করুন। অন্তত তিন-চার দিন পর পর করা ভালো। এডিস মশা সাধারণত দিনের প্রথম ভাগে (সকালে) ও শেষ ভাগে (বিকালে) বেশি কামড়ায়। তবে রাতে ও অন্যান্য সময়ও কামড়াতে পারে। এ জন্য সব সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করা উচিত।

লেখক :  সাবেক ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর