মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাপ দংশনেই কী মানুষ মারা যায়?

নাহিদুর রহমান হিমেল

সাপ দংশনেই কী মানুষ মারা যায়?

মানুষের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম সাপ। পৃথিবীতে একমাত্র এন্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই সাপের দেখা মেলে। জল ও স্থল উভয় স্থানেই বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বসবাস করলেও স্থলেই এদের বেশি দেখা যায়। হাত-পা বিহীন এই লম্বা সরীসৃপের প্রতি মানুষের যেন কৌতূহলের শেষ নেই। এই প্রাণীটি নিয়ে আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে নানা মিথ বা গল্পকথা। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে অনেক বেশি কুসংস্কার প্রচলিত। অনেকেরই মনে প্রশ্ন রয়েছে- আসলে সাপের দংশনেই কী মানুষ মারা যায়? এক্ষেত্রে সাপ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরা বলছেন, সাপ দংশন করলেই মানুষ মারা যায় না। এটি নির্ভর করে কোন ধরনের সাপ দংশন করেছে এবং রোগীর শারীরিক গঠনের ওপর। বিষক্রিয়ার ভিত্তিতে সাপকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলো হলো- বিষহীন বা নির্বিষ সাপ, ক্ষীণ বিষধর সাপ এবং বিষাক্ত বা মারাত্মক বিষধর সাপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- কোনো সাপ দংশন করল এবং রোগীকে কেমন চিকিৎসা দেওয়া হলো, তার ওপর নির্ভর করবে রোগী কত দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে, বা অঙ্গহানি বা মারা যাবে কিনা। দীর্ঘদিন সাপ ও কুমির নিয়ে কাজ করা বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ সাপই নির্বিষ। বিষাক্ত সাপের প্রজাতি ১০ শতাংশেরও কম। তিনি বলেন, প্রতিবছর দেশে সাপের দংশনে যত মানুষ মারা যায় তার বেশির ভাগই নির্বিষ সাপের দংশনে আতঙ্কিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। এটি অপ্রত্যাশিত। বিষধর সাপের দংশনের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিষ প্রতিষেধক প্রয়োজন। তবে ক্ষীণ বিষধর সাপ যদি বারবার দংশন করে এবং রোগীর শারীরিক গঠন যদি দুর্বল হয় সেক্ষেত্রে তার কিছুটা সমস্যা হতে পারে। নির্বিষ বা ক্ষীণ বিষধর সাপের দংশনে মানুষের মৃত্যু হয় না। সুতরাং কেউ যদি বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন তাহলে তাকে অবশ্যই  দ্রুত চিকিৎসকরে পরামর্শ অনুযায়ী বিষ প্রতিষেধক নিতে হবে। তিনি জানান, দেশে কোবরা বা গোখরা সাপের তিন প্রজাতি রয়েছে। এরা সাধারণত দংশন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষ অপচয় করতে পছন্দ করে না। এদের প্রায় ৫০ শতাংশ দংশন বিষহীন হয়। এরা নিজেদের জন্য ক্ষতিকর মনে করলে দংশন দেওয়ার সময় পুরো বিষ ঢেলে দেয়। তবে এক্ষেত্রে একদম উল্টো হলো কমন ক্রেইট বা কালাচ। এরা নীরব ঘাতক। এরা প্রতিটি দংশনে ১০০ শতাংশ বিষ ঢেলে থাকে। সাপে কাটা রোগীদের নিয়ে কাজ করা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. সাকিত মাহমুদ বলেন, সাপের মুখের ভিতর চোখ বরাবর ও কিছুটা পেছনে উপরের চোয়ালের দুই পাশে থাকে বিষথলি। এই বিষথলি হলো রূপান্তরিত লালাগ্রন্থি। সাপের শরীরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বিষ মূলত এক ধরনের রূপান্তরিত লালা যা এই গ্রন্থিতে সংরক্ষিত থাকে। এই গ্রন্থি থেকে বিষ অতি সূক্ষ্ম নালী তাদের বিষ দাঁতে প্রবেশ করে। বিষধর সাপের একজোড়া দাঁত অনেকটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জের মতো যা দিয়ে তারা বিষ ঢেলে দেয়। বিষ প্রয়োগ করার পুরো প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগে।

তিনি আরও বলেন, সাপের বিষের মধ্যে থাকা টক্সিনগুলো কয়েকভাবে দেহকে আক্রান্ত করতে পারে। এর মধ্যে প্রধানত চারটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো- হেমোটক্সিন্স, নিউরোটক্সিন্স, কার্ডিওটক্সিন্স ও সাইটোটক্সিন। হেমোটক্সিন্স রক্তের লোহিত কণিকাকে বিভক্ত করে অথবা রক্তে অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক জমাট বাঁধিয়ে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। সাধারণত ভাইপার প্রজাতির বিষধর সাপ এমন বিষ ছড়ায়।

নিউরোটক্সিন্স দেহের মাংসপেশিসহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ করে দিতে পারে। এটি স্নায়ু ও মাংসপেশির সংযোগস্থলে নানাভাবে আক্রান্ত করার মধ্য দিয়ে এমনটা করে থাকে। সাধারণত গোখরা, কেউটে, রাসেল ভাইপার, র‌্যাটেল স্নেক ইত্যাদি বিষধর সাপের দংশনে এমনটা হয়ে থাকে। নিউরোটক্সিনের প্রধান ভয়াবহতার কারণ হলো- শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যবহৃত মাংসপেশিকে বিকল করে শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটাতে পারে। কার্ডিওটক্সিন্স সরাসরি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে মানুষের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। আর সাইটোটক্সিন আক্রান্ত অঞ্চলে ফোলা, মাংসপেশিতে পচনসহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিসাধন এমনকি কিডনি বিকল করে দিতে সক্ষম। ডা. সাকিত মাহমুদ বলেন, সব প্রাণীরই বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন জীবাণু/টক্সিন/এন্টিজেন- যা প্রাণীর শরীরে অনুপ্রবেশ করে, তার থেকে মুক্তির জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ইমিউনো সিস্টেম রয়েছে। আমাদের শরীরে বাইরে থেকে কোনো রোগ জীবাণু প্রবেশ করলে শরীর নিজে থেকেই তার অ্যান্টিবডি তৈরি করে নেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য; সাপের বিষ শরীরে প্রবেশ করলে তা নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা মানব শরীরে নেই। তখন প্রয়োজন হয় বাইরে থেকে টক্সিন নিউট্রিলাইজার এন্টিবডি সমৃদ্ধ সিরাম মানব শরীরে প্রবেশ করানো। এই এন্টিস্নেক ভেনম সিরাম মানব শরীরে প্রবেশ করালে রক্তে বিদ্যমান এন্টিবডির মাত্রা অতিমাত্রায় বেড়ে সাপের বিষকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়।

এদিকে নির্বিষ বা ক্ষীণ বিষধর সাপের দংশনের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, পৃথিবীতে নির্বিষ বা ক্ষীণবিষধর সাপের পরিমাণই বেশি। এদের বেশির ভাগ কলুব্রিড পরিবারের। এদের দংশনে ক্ষতস্থানে জ্বালাপোড়া, ফুলে যাওয়া ছাড়া তেমন বিশেষ সমস্যা হয় না। তবে নির্বিষ বা ক্ষীণ বিষধর সাপের দংশনেও দুর্বল চিত্তের মানুষের কিংবা আগে হৃদরোগ রয়েছে, অতি বৃদ্ধ, এমন লোকদের আতঙ্কজনিত কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

সর্বশেষ খবর