শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

হার্ট ব্লকের বাস্তবতা

হার্ট ব্লকের বাস্তবতা

মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ পেয়ে থাকে। রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষ প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও খাদ্যবস্তু গ্রহণ করে থাকে এবং কোষে উৎপাদিত বর্জ্যপদার্থ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে থাকে। এখানে কোষ বলতে শরীরের ক্ষুদ্রতম ইউনিটকে বোঝানো হয়েছে। প্রতিটি অঙ্গই হাজার হাজার কোষের সমষ্টি। মানবদেহ কোটি কোটি জীবন্ত কোষের সমাহার ছাড়া আর কিছুই নয়, প্রতিটি কোষ জীবন্ত বলে তাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন ও খাদ্য বস্তুর প্রয়োজন হয় এবং মেটাবলিক (বিপাকীয়) কর্মকান্ডের ফলে বর্জ্য-পদার্থ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। যদি কোনো কারণে শরীরের কোনো অঙ্গ বা অঙ্গের অংশবিশেষ রক্ত সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়, তবে অক্সিজেন ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধের ফলে ওই অঙ্গের আক্রান্ত কোষসমূহের মৃত্যু ঘটে। যার ফলে কোনো অঙ্গ একবারে নষ্ট হয়ে যেতে পারে অথবা অঙ্গের অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সেই অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ে। মানবদেহের অন্যান্য অঙ্গের মতো হার্ট ও রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ পেয়ে থাকে। হার্টের রক্তনালিকে করোনারি রক্তনালি বলা হয়ে থাকে। যদি কোনো কারণে করোনারি রক্তনালি আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, তবে এই অবস্থাকে সাধারণভাবে হার্ট ব্লক বলা হয়ে থাকে। হার্ট ব্লকের ফলশ্রুতিতে হার্ট সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে নষ্ট হয়ে মরে যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে মাইয়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ফলে ব্যক্তির হার্ট দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং অনেকের হার্ট পুরোপুরি অকেজো হওয়ার ফলে ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। মাইয়ো-কার্ডিয়াল ইনফার্কশন সাধারণভাবে হঠাৎ ঘটে থাকে এবং প্রায় ৯০% ব্যক্তিই পূর্ব থেকে হার্ট ব্লকে আক্রান্ত থাকেন। মাইয়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ছাড়া ও হার্ট ব্লকের রোগীরা বেশ কিছু লক্ষণ নিয়ে জীবনযাপন করে থাকেন। যেমন অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, বুকে চাপ ও ব্যথা অনুভূত হওয়া এবং বিশ্রাম গ্রহণ করলে বা পরিশ্রম করা বন্ধ করলে খুব তাড়াতাড়ি উল্লিখিত উপসর্গগুলো দূরীভূত হয়ে রোগী সুস্থতা বোধ করে থাকেন, অনেকে এ অবস্থাকে গ্যাসজনিত সমস্যা বলে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। হার্ট ব্লক কেন হয়ে থাকে তা জানতে পারলে হয়তো আগে থেকেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। রক্তনালির দেয়ালের ভেতর দিকে স্থানে স্থানে চর্বি জাতীয় পদার্থ জমা হয়ে রক্তনালির ভেতরে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার মতো ফাঁপা জায়গা ধীরে ধীরে বন্ধ করতে থাকে ফলশ্রুতিতে রক্ত প্রবাহের পথ বন্ধ হওয়ায় রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। এ অবস্থা শুধু হৃৎপিন্ডের বা হার্টের রক্তনালিতেই ঘটতে দেখা যায় না, যেমন- ব্রেন, কিডনি, লিভার, হাত-পা ইত্যাদি সব অঙ্গেই ঘটে থাকে। বেশ কিছু শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, বংশগত, আচরণগত অবস্থার সঙ্গে এ ধরনের অসুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন- ধূমপান, অতিমাত্রায় পশুর চর্বিযুক্ত খাদ্যব¯ুÍ গ্রহণ, অলস জীবনধারণ ইত্যাদি। উচ্চরক্তচাপে ভোগা, ডায়াবেটিসে ভোগা, রক্তে উচ্চমাত্রার কলেস্টেরল নামক চর্বি জাতীয় পদার্থ বিদ্যমান থাকা, শাকসবজি না খাওয়া বা অল্প পরিমাণে খাওয়া বংশগত প্রবণতা এ ধরনের অসুস্থতা বিদ্যমান থাকা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবনাতিপাত করা ইত্যাদি। এত সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানুষের বয়োবৃদ্ধি। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তথা সব প্রাণিকুলের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, যাকে জরাগ্রস্ত হওয়া বলে। জরাগ্রস্ত হওয়ার ফলে মানবদেহের প্রতিটি কোষে বেশ কিছু পরির্বতন পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। যাকে কোনো ব¯ুÍ পুরনো হয়ে যাওয়া বা ক্ষয় হয়ে যাওয়া বলে বোঝানো হয়ে থাকে।  দিনে দিনে কোষগুলো দুর্বল হতে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও কোষ মেরামত হওয়ার যোগ্যতা কমতে থাকে। বর্তমান সময়ে হার্ট ব্লকের চিকিৎসায় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যেমন-চিকিৎসার মাধ্যমে রক্তের উচ্চমাত্রার সুগার (ডায়াবেটিস) নিয়ন্ত্রণ করা, রক্তের উচ্চমাত্রার কলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা, রক্তনালি প্রসারিত হওয়ার মেডিসিন গ্রহণ করা, অল্প অক্সিজেনের মাধ্যমে হার্টের কার্যকারিতা সংরক্ষণ করার মতো মেডিসিন গ্রহণ করা, রক্ত যাতে সহজে জমাট বাঁধতে না পারে। তার জন্য রক্ত তরল রাখার মতো ওষুধ সেবন করা। বুকের ব্যথা কম হওয়ার জন্য মেডিসিন গ্রহণ করা। এ ছাড়া হৃদবান্ধব খাদ্যাভ্যাসের চর্চা করা। নিয়মিত কায়িকশ্রম সম্পাদনের অভ্যাস করা। ধূমপান ও তামাকজাতীয় খাদ্যব¯ুÍ বর্জন করা। মেডিটেশন ও ধ্যান এ যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এবং টেনশন দূর করে মানসিক প্রশান্তি আনায়ন করা।

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা মানে হার্ট ব্লকের পরিমাণ বা তীব্রতা এনজিওগ্রামের মাধ্যমে নির্ণয় করে রিং অথবা বাইপাস অপারেশন বা ইসিপি থেরাপির মাধ্যমে হার্টব্লক দূরীভূত করা। এসব চিকিৎসার ফলে রোগীর হার্ট ব্লকের তীব্রতা অনেকাংশে কমে গিয়ে রোগী সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করার প্রয়াস পেয়ে থাকেন। তবে আগেই বলেছি, হার্ট ব্লকের সবচেয়ে বড় কারণ ব্যক্তির বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হার্ট ব্লক বৃদ্ধি পাবে। এটা স্বতঃসিদ্ধ, তাই অন্যভাবে বলতে গেলে উপরোল্লিখিত সব ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও হার্ট ব্লক সম্পূর্ণ নিরাময় না হয়ে কোনো না কোনো পর্যায় পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। তাই বলা যেতে পারে, হৃদরোগ ডায়াবেটিস অন্যান্য অসুস্থতার মতো হার্ট ব্লক নিয়ন্ত্রণে রেখেই জীবনধারণ করতে হবে।

ডা. এম শমশের আলী (কার্ডিওলজিস্ট)

সিনিয়র কনসালটেন্ট (প্রা.), ঢাকা মেডিকেল

কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর