সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
প্রেসক্রিপশন

হার্ট ফেইলিওর ও করণীয়

অধ্যাপক ডা. এএইচএম ওয়ালিউল ইসলাম

হার্ট ফেইলিওর ও করণীয়

আমাদের শরীরের ঠিক বুকের মাঝে অবস্থিত হৃৎপিন্ড মায়ের গর্ভাবস্থায় ২২ দিন থেকে আমৃত্যু দেহের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমূহে শোধিত রক্ত ও জীবকোষসমূহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য তথা বিভিন্ন জৈব উপাদান সরবরাহ করে যা কিনা পরিশেষে আমাদের সুস্বাস্থ্য ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।

আমরা প্রায়ই দেখে থাকি বা অনেক সময় রোগীরা বলে থাকেন যে, কদিন আগে ভালোই ছিলাম কিন্তু এখন একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠি, একতলা থেকে দোতলা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারি না, বেশিক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলতে পারি না, খাবার খেলে হাঁপিয়ে ওঠি, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া, চিত হয়ে শুতে পারি না, রাতে ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টে ওঠে বসে থাকি। মনে রাখতে হবে, প্রথমেই ভালো করে দেখে নেওয়া ভালো যে এর জন্য হার্ট না কি ফুসফুসের অসুস্থতা দায়ী। তন্মধ্যে অ্যাজমা, COPD, interstitial lung disease ফুসফুসজনিত শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে, বয়স ৪৫-৫০, পুরুষ রোগী, বহুমূত্র রোগ, রক্তে অস্বাভাবিক মাত্রার কোলেস্টেরল (বিশেষ করে LDL cholesterol), hereditary, জন্মগত সম্পৃক্ততা অধিকাংশই হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ হয়ে থাকে। আর  এই হার্ট অ্যাটাকের ফলে রোগীর হৃৎপিন্ডের মাংসপেশীসমূহ ঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার ফলে ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে ওঠে। ফলে, শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী হার্ট পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। এ অবস্থাকে হার্ট ফেইলিওর বলা হয়। হৃদযন্ত্রের প্রকোষ্ঠ রক্তে পরিপূর্ণ না হলে বা দেয়ালে পর্যাপ্ত শক্তি না থাকার কারণে এমনটি হতে পারে। এটা অবশ্যই মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে হার্ট ফেইলিওর মানে হৃৎপিন্ড থেমে বা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়।

হার্ট ফেইলিওরের কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য করোনারি ধমনিতে (coronary artery) অন্তঃস্থিত গাত্রে (endothelium) এর নিচে LDL cholesterol জমে ধমনির গহ্বর সংকীর্ণ করার ফলে হার্ট অ্যাটাক করে। এর ফলে, চর্বির দলা ফেটে জমাট রক্ত হার্টের মাংসপেশিতে  অক্সিজেন ও সুষম খাদ্য সরবরাহ ব্যাঘাত ঘটায়, ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্রের দেয়ালের মাংসপেশিসমূহ দুর্বল ও কালান্তরে হার্ট ফেইলিওর ঘটায়। উচ্চরক্তচাপ, রক্তে চর্বির আধিক্য, গ্লুুকোজের পরিমাণ বেশিও হার্ট অ্যাটাক তথা হার্ট ফেইলিওর ঘটাতে সহায়তা করে থাকে। জন্মগত কারণে বিশেষ করে জেনেটিক (congenital muscle dzstrophy), অ্যালকোহল, সংক্রমণজনিত (dengue myocarditis), সহ অন্য ভাইরাসের সংক্রমণে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে।

লক্ষণসমূহের মধ্যে অল্পেই হাঁপিয়ে ওঠা, পায়ে পানি জমা, সিঁড়ি বাইতে না পারা, চিৎ হয়ে শুতে না পারা,  অরুচি, পেট ভরা ভাব, দ্রুত হৃদস্পন্দন অনুভূত হওয়া, কাজকর্মে মনোযোগী না হতে পারা, কথাবার্তা চালচলনে অসামঞ্জস্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্মৃতিহীনতা প্রকাশ পেতে পারে। বুক ধড়ফড় বা palpitation, রক্তচাপ কমে আসা, ঘনঘন ফুসফুসে পানি জমা, পায়ের গোড়ালিতে পানি জমে ফুলে যেতে পারে। শুরুতেই হৃদরোগ নির্নয় ও এর কারণসমূহ শনাক্তকরণ ও যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হার্ট ফেইলিওর হতে রোগীকে রক্ষা করা যেতে পারে। রোগের নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে মূল চিকিৎসা। জীবনধারার পরিবর্তন, ওষুধ সেবন তথা হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ ডিভাইস যেমন AICD, CRT-D বা ক্ষেত্রবিশেষে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন পারে হার্ট ফেইলিওর রোগীর সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন। এছাড়া যদি হার্টের ভাল্বের ধন্য ফেইলিওর হয়, তাহলে হার্টের ভাল্বের প্রতিস্থাপন করলে উন্নতি পরিলক্ষিত হতে পারে।

সুশৃঙ্খল জীবনযাপনই হার্ট ফেইলিওর রোগীর উপসর্গ কমাতে পারা তথা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। নিয়মিত ওষুধ সেবন, পানি পরিমিত সর্বসাকুল্যে ৮০০-১২০০ মিলি (বেশি পানি ফুসফুস তথা পায়ে জমাতে পারে যাতে করে রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে), সহজে হজম হয় এমন নরম খাবার তিনবারের স্থানে ছয়বার খাওয়া শ্রেয়। সহনীয় পর্যায়ে কায়িক পরিশ্রম বা হাঁটা, ধূমপান, অ্যালকোহল বর্জন, বাড়তি বা আলগা কাঁচা লবণ না খাওয়াসহ রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণই পারে হার্ট ফেইলিওর রোগীকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে। মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম। প্রাথমিক অবস্থায় হার্টের এসব লক্ষণে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে জটিলতা অনেকটাই এড়ানো যায়। তাই অবহেলা না করে হার্টের বিভিন্ন সমস্যা ও রোগের লক্ষণ নিয়ে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এতে করে অনেক জটিলতা প্রাথমিক অবস্থায় এড়ানো যায়।

লেখক : ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, এ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর