শিরোনাম
শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্রয়োজন আছে কি?

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্রয়োজন আছে কি?

করোনাভাইরাস গোত্রের একটি হলো কোভিড-১৯, যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক ত্রাস সৃষ্টিকারী রোগ। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশকে করোনা আক্রান্তের উচ্চ-ঝুঁকির দেশ হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সংস্থা থেকে সতর্ক করা হচ্ছিল। সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর প্রকাশের পর পরই জনগণের মাঝে একদিকে যেমন ভয়ানক আতঙ্ক বেড়েছে, তেমনি মানুষ করোনার হাত থেকে নিজ নিজ সুরক্ষার জন্য যে যেভাবে পারছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এই সুযোগে বাজারের মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ এবং হ্যান্ড-স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য মেডিকেল সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে গেছে। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে বিক্রেতারা, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এসব পণ্য কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে মাস্ক ব্যবহারে এ রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকা যাবে কিনা, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি।

কোভিড-১৯ একটি নতুন রোগ, মাস তিনেকের মধ্যে যা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এই রোগ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র নতুন নতুন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য আসছে, আবার আবিষ্কৃত নতুন অনেক তথ্য পুরনো ধারণাকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। তবে মাস্ক এবং হ্যান্ড-স্যানিটাইজার নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে সে সংক্রান্ত এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও পালিত তথ্য নিচে প্রদান করা হলো, যা সবাই মেনে চললে করোনা মোকাবিলা সহজ হবে। প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, সুস্থ সাধারণ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না, বরং তা হাঁচি কাশি এবং জীবাণুযুক্ত হাতের স্পর্শে বেশি বেশি ছাড়ায়। ভাইরাসগুলো তুলনামূলক ভারী। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির মাধ্যমে নির্গত ভাইরাস এক মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না, বরং তা মাটি বা ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। তাই দেখা যায়, শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির এক মিটারের মধ্যে কোনো মানুষ থাকলে তার মধ্যে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে, অন্যথায় রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তাই গণহারে, রাস্তাঘাটে ঢালাও মাস্ক পরে চলাফেরার কোনো যুক্তিই নেই। বরং অন্যকে রক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরবেন আক্রান্ত ব্যক্তি যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ বা নাক থেকে ভাইরাস বা জীবাণু অন্য মানুষে ছড়িয়ে না পড়ে। পাশাপাশি আক্রান্ত বা কোয়ারেন্টাইনে রাখা রোগীদের সেবাদানকারী ডাক্তার, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। বিদেশফেরত যাদের বাড়িতে নিজেদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা এবং তাদের সেবাদানকারী পরিবারের লোকজন এবং আশপাশের লোকজন শুধু একই ঘরে থাকার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। তবে শুধু মাস্ক পরলেই হবে না, সেই সঙ্গে কিছু নিয়মও মানতে হবে। যেমন কিছুক্ষণ পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া অব্যাহত রাখতে হবে, নিয়মিত মাস্ক পরিবর্তন করতে হবে, ব্যবহারের পর মাস্ক যেখানে সেখানে না ফেলে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ফেলতে হবে এবং পরবর্তীতে তা পুড়িয়ে ফেলা ভালো।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে, মাস্ক ব্যবহার করার চেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাবান-পানি দিয়ে ঘন ঘন কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া। কারণ হাঁচি-কাশির সময় হাত ব্যবহার করলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর হাত থেকে তা অন্যান্য স্থানে ছড়াতে পারে। অর্থাৎ রোগী যেখানে স্পর্শ করবেন সেখানেই এ ভাইরাস ছড়িয়ে যায়। দরজায় হাত দিলে সেখানে ছড়িয়ে পড়বে, চেয়ার-টেবিল স্পর্শ করলে সেখানে ছড়াবে, টেলিফোন, কিবোর্ড যাই স্পর্শ করবেন সেখানে ছড়াবে। তাই ঘরের আসবাবপত্র, টেবিল-চেয়ার, মেঝে পরিষ্কার রাখবেন। তবে হাত ধোয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভ্রান্তি। হাত ধুতে সাবান-পানি ব্যবহার করলেই চলে। কেউ চাইলে হ্যান্ডওয়াশ এবং হ্যান্ড-স্যানিটাইজার হাত ধোয়ার কাজে ব্যবহার করতে পারেন। তবে সবাই হ্যান্ড-স্যানিটাইজারে ঝুঁকে পড়ায়, দাম বেড়েছে অনেকগুণ, বাজারে হয়েছে সংকট। তাই এগুলোর পিছনে ছোটার কোনো দরকার নেই। বরং সহসলভ্য, তুলনামূলক সস্তা সাবান-পানি দিয়ে ন্যূনতম ২০ সেকেন্ড ভালোভাবে হাত ধুঁয়েই করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব।

পরিশেষে বলতে চাই, করোনাভাইরাস নিয়ে ভয় পাবেন না, আতঙ্কিত হবেন না। এমনকি কোনো চিকিৎসা না নিলে কিংবা ঘরে বসে সর্দি-জ্বরের মতো চিকিৎসা নিলেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীই ভালো হয়ে যায়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত মাত্র ২০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে এবং ২-৩ শতাংশকে আইসিইউতে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। তবে আমাদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। ভয়ের পরিবর্তে মানুষ যদি অধিকতর সচেতন থাকে, তাহলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা কঠিন কিছু নয়।

যদি এটি একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমণের সুযোগ না পায়, তাহলে তা ছড়াবে না। আবার দ্রুত সময়ের মধ্যে শনাক্ত করা গেলে ব্যবস্থাপনা কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। নতুন এই করোনাভাইরাসের জন্য কোনো টিকা বা চিকিৎসা উদ্ভাবন না হলেও আনুষঙ্গিক অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

লেখক : প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও  প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর