শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

কোয়ারেন্টাইন নিজে বাঁচুন অন্যকে বাঁচান

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু

কোয়ারেন্টাইন নিজে বাঁচুন অন্যকে বাঁচান

বর্তমানে সারা বিশ্বে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে কোয়ারেন্টাইন। ল্যাটিন শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। চতুর্দশ  শতাব্দীর মধ্য ভাগে ইউরোপের প্লাগের প্রাদুর্ভাবের সময়ে ইতালির ভেনিস বন্দরে আসা জাহাজগুলোকে ভিড়তে না দিয়ে ৪০ দিন বন্দর থেকে দেড় মাইল দূরে নোঙর করে রাখতে হতো; সেখান থেকেই শুরু হয় এই কোয়ারেন্টাইনের ধারণা, এর পরে বিভিন্ন সময়ে যক্ষ্মা, গুটিবসন্ত, সার্স/মার্স, এবোলা, কলেরা, ডিপথেরিয়া, ইয়োলো ফিবারসহ ছোঁয়াছে রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে এই কোয়ারেন্টাইন মোক্ষম অস্ত্র। আমেরিকার প্রথম এই কোয়ারেন্টাইন আইন চালু হয় ১৯৪৪ সালে। কোয়ারেন্টাইন এ রাখা ব্যক্তির অবশ্যই প্রতি পালনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে তিনি নিজে পরিবার ও সমাজের জন্য অনেক বড় ক্ষতি বয়ে আনতে পারেন; হতে পারেন অনেকের সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণ। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতাটি সম্পর্কে সম্ভবত কোনো ধারণা আমাদের অনেকেরই নেই। হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা/নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে: বাড়ির অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকুন। আলো বাতাসের সুব্যবস্থা সম্পন্ন আলাদা ঘরে থাকুন এবং অন্য সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে থাকুন। তা সম্ভব না হলে, অন্যদের থেকে অন্তত এক মিটার (৩ ফুট) দূরে থাকুন (ঘুমানোর জন্য পৃথক বিছানা ব্যবহার করুন)। * যদি সম্ভব হয় তাহলে আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেট ব্যবহার করুন। সম্ভব না হলে, অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এমন স্থানের সংখ্যা কমান ও ওই স্থানগুলোতে জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করুন। * মাস্ক ব্যবহার করুন, মাস্ক পরে থাকাকালীন এটি হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকুন। মাস্ক ব্যবহারের সময় প্রদাহের (সর্দি, থুথু, কাশি, বমি ইত্যাদি) সংস্পর্শে আসলে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলুন এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করুন।

মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলুন এবং সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। * সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন (বিশেষ করে যদি হাত দেখতে নোংরা লাগে সাবান-পানি ব্যবহার করুন)। প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না। সাবান-পানি ব্যবহারের পর টিস্যু দিয়ে হাত শুকনো করে ফেলুন। টিস্যু না থাকলে শুধু হাত মোছার জন্য নির্দিষ্ট তোয়ালে/ গামছা ব্যবহার করুন এবং ভিজে গেলে বদলে ফেলুন। * মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি দিন

কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি কাশির সময় টিস্যু পেপার/ মেডিকেল মাস্ক/ কাপড়ের মাস্ক/ বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখুন এবং উপরের নিয়মানুযায়ী হাত পরিষ্কার করুন। টিস্যু পেপার ও মেডিকেল মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলুন। * আপনার খাওয়ার বাসনপত্র-থালা, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি তোয়ালে, বিছানার চাদর অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না। এসব জিনিসপত্র ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন। * চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার কোয়ারেন্টিন শেষ হবে। চিকিৎসকের সিদ্ধান্তমতে একজন হতে অন্যজনের কোয়ারেন্টাইনের সময়সীমা আলাদা হতে পারে। তবে, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ সময়সীমা ১৪ দিন। * পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ফোন/ মোবাইল /ইন্টারনেটের সাহায্যে যোগাযোগ রাখুন। শিশুকে তার জন্য প্রযোজ্যভাবে বোঝান। তাদের পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী দিন এবং  খেলার পরে জীবাণুমুক্ত করুন।

পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্দেশাবলী

বর্তমানে সুস্থ আছেন এবং যার দীর্ঘমেয়াদি রোগসমূহ (যেমন : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, অ্যাজমা প্রভৃতি) নেই, এমন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে পরিচর্যাকারী হিসেবে নিয়োজিত হতে পারেন। তিনি ওই ঘরে বা পাশের ঘরে থাকবেন, অবস্থান বদল করবেন না। * কোয়ারেন্টাইনে আছেন এমন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো অতিথিকে দেখা করতে দেবেন না। পরিচর্যাকারী নিম্নলিখিত যে কোনো কাজ করার পর প্রতিবার উপরের নিয়মে দুই হাত পরিষ্কার করবেন-* কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বাতার ঘরে ঢুকলে * খাবার তৈরির আগে ও পরে * খাবার আগে * টয়লেট ব্যবহারের পরে * গ্লাভস পরার আগে ও খোলার পরে * যখনই হাত দেখে নোংরা মনে হয়। খালি হাতে ওই ঘরের কোনো কিছু স্পর্শ করবেন না। * কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তির ব্যবহৃত বা তার পরিচর্যায় ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস, টিস্যু ইত্যাদি অথবা অন্য আবর্জনা ওই রুমে রাখা ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে রাখুন। এসব আবর্জনা উন্মুক্ত স্থানে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলুন।

যদি কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট/ ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি/কাশি/সর্দি/গলাব্যথা/শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি), তবে অতি দ্রুত আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে অবশ্যই যোগাযোগ করুন এবং পরবর্তী করণীয় জেনে নিন।

মনে রাখবেন উপযুক্ত কোনো ব্যক্তির ওপর কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তা অমান্য করা এবং তথ্য গোপন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর আওতায় কারাদন্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। তাই সবাই সচেতন হোন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, নাক-কান-গলা বিভাগ, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর