বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

যক্ষ্মার উপসর্গ ও করণীয়

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান

যক্ষ্মার উপসর্গ ও করণীয়
শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেও যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় যক্ষ্মার জীবাণু ফুসফুসে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে, এর ফলে যক্ষ্মার সংক্রামক রোগ হতে পারে। তবে এর উপসর্গগুলো তেমন বোঝা যায় না এবং রোগ ছড়ায় না, বরং সুপ্ত অবস্থায় থাকে।

যক্ষ্মা এখনো বড় একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। এতে শুধু যে নিম্ন আয়ের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়, বরং রোগটা যে কারও হতে পারে। সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসাই যক্ষ্মা থেকে রক্ষা করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার যক্ষ্মা রোগী মারা যাচ্ছে। সারা বিশ্বে এ সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।

কারা বেশি ঝুঁকিতে : যক্ষ্মা রোগীর কাছাকাছি থাকেন এমন লোকজন যেমন, পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক, নার্স বা সেবা-শুশ্রƒষাকারীর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মাদকাসক্তি, বার্ধক্য, অপুষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যক্ষ্মার ঝুঁকি থাকে। আবার যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম- যেমন, এইডস রোগী, দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধসেবী মানুষের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সঠিক  চিকিৎসায় রোগটিকে সারিয়ে তোলা যায়। তবে আবার নতুন এক মারাত্মক রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে অসুখটি, অনেক ক্ষেত্রে হয়ে পড়ছে ওষুধ প্রতিরোধী। সাধারণ যক্ষ্মা রোগীকে নিয়ম মেনে দৈনিক ওষুধ খেতে হয় টানা ছয় মাস। ছয় মাসের কোর্স শেষ না করলে, নিয়ম মেনে ওষুধ না খেলে, মানসম্পন্ন ওষুধ না খেলে চিকিৎসা কার্যকর হয় না। যক্ষ্মার জীবাণু ওষুধ সহনশীল হয়ে পড়ে। ওই ওষুধে জীবাণু ধ্বংস হয় না, রোগী ভালো হয় না। এটাই এমডিআর যক্ষ্মা। যাদের রোগ নির্ণয় হয় না বা ওষুধ খায় না তাদের কারণেই ঝুঁকি বাড়ছে। চিকিৎসা না হলে প্রতিটি রোগী আরও ১০ জনকে আক্রান্ত করাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৫ হাজার রোগীর মধ্যে ৪ হাজার শনাক্তের বাইরে। আর এ চার হাজার রোগীর প্রতিজন বছরে দশজনকে আক্রান্ত করতে পারেন-এ আশঙ্কা থাকে সব সময়ই। রোগী যেমন বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়, তেমনি এমডিআর বা এক্সডিআর যক্ষ্মার রোগী সরাসরি এমডিআর বা এক্সডিআর যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে এমডিআর যক্ষ্মা রোগী আছে ৫ হাজার ৩০০। বর্তমানে চিকিৎসার আওতায় ৯২০ জন। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসাবে ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।

যক্ষ্মা কেবল ফুসফুসে হয় না : শতকরা ৮৫ ভাগ যক্ষ্মা ফুসফুসে হয়ে থাকে। ফুসফুসের আবরণী- যাকে বলা হয়ে থাকে প্লুরা, সেখানে। লসিকা গ্রন্থি। মস্তিষ্কের আবরণী। হাড়, অন্ত্র ও ত্বক। শুধু হৃৎপি-, নখ এবং চুল যক্ষ্মা রোগের আওতামুক্ত।

ফুসফুসের যক্ষ্মা আবার দুই ধরনের স্পুটাম স্মিয়ার পজিটিভ বা কফে জীবাণুযুক্ত যক্ষ্মা রোগী এবং স্পুটাম স্মিয়ার নেগেটিভ বা কফ জীবাণুযুক্ত যক্ষ্মা রোগী। এই দুই গ্রুপের মধ্যে স্মিয়ার স্পুটাম পজিটিভ রোগীরাই মারাত্মক সংক্রামক। এদের ফুসফুস থেকে নির্গত যক্ষ্মা জীবাণু বাতাসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সুস্থ লোকের শরীরে প্রবেশ করে এবং নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পর এদের মধ্যে কেউ কেউ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসার আওতায় আসেনি এমন একজন স্পুটাম স্মিয়ার পজিটিভ রোগী বছরে একজন করে নতুন যক্ষ্মা রোগীর জন্ম দেয়।

যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলেই কি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হবে : যক্ষ্মা রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলেও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত নাও হতে পারে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেও যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় যক্ষ্মার জীবাণু ফুসফুসে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে, এর ফলে যক্ষ্মার সংক্রামক রোগ হতে পারে। তবে এর উপসর্গগুলো তেমন বোঝা যায় না এবং রোগ ছড়ায় না, বরং সুপ্ত অবস্থায় থাকে।

যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যক্ষ্মার জীবাণু খুব দ্রুত তাদের শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং দ্রুতাকারে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় রক্ষাকারী কোষগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে। একে সক্রিয় যক্ষ্মা বলা হয়ে থাকে। আবার বছরের পর বছর যদি যক্ষ্মা রোগের জীবাণু শরীরে থেকে যায়, তাহলে কোনো এক সময় পরবর্তীতে সুপ্ত যক্ষ্মা থেকে সক্রিয় যক্ষ্মায় রূপ নিতে পারে।

ফুসফুসের যক্ষ্মার লক্ষণ : তিন সপ্তাহের অধিক সময় ধরে কাশি (শুকনো/কফ যুক্ত) অন্যতম লক্ষণ। কাশির সঙ্গে রক্ত যেতেও পারে না-ও যেতে পারে, বুকে ব্যথা হওয়া, অস্বাভাবিকভাবে ওজন হ্রাস পাওয়া, অবসাদ অনুভব করা, সন্ধ্যায় হালকা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর (৯৯-১০১ ডিগ্রি) থাকতেও পারে/না-ও থাকতে পারে, অতিরিক্ত  ঘাম, ক্ষুধা মন্দা।

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা : যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা সাধারণত দুই ভাগে বা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়ে থাকে।

ক্যাটাগরি এক : ছয় মাস ধরে ওষুধ খাওয়া।

ক্যাটাগরি দুই : আট/নয় মাস ধরে ওষুধ খাওয়া। এছাড়া, চিকিৎসা ব্যর্থতা কিংবা রোগী পুনরায় যক্ষ্মা আক্রান্ত হলে সেভাবেই চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়।

কখন সতর্ক হবেন : তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাশি (কাশির সঙ্গে রক্ত যেতেও পারে, না-ও যেতে পারে), জ্বর, অরুচি, ওজন কমা, অবসাদ ইত্যাদি দেখা দিলে অবশ্যই যক্ষ্মা পরীক্ষা করা উচিত। এর বাইরে দীর্ঘক্ষণ ধরে লসিকাগ্রন্থির স্ফীতি, মলত্যাগের অভ্যাসে আকস্মিক পরিবর্তন, কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য কখনো ডায়রিয়া, বুকে বা পেটে পানি জমা ইত্যাদিও যক্ষ্মার উপসর্গ হিসেবে বিবেচ্য।

যক্ষ্মা প্রতিরোধে কি করণীয় : যক্ষ্মা প্রতিরোধে জন্মের পরপর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দেওয়া। ফুসফুসের  যক্ষ্মা ছোঁয়াচে। কেবল স্পর্শে এই রোগ ছড়াই না। এই রোগ ছড়াই হাঁচি, কাশি আর কফের মাধ্যমে। তাই রাস্তাঘাটে হাঁচি-কাশির বেগ এলে মুখে রুমাল চাপা দেওয়া উচিত। যত্রতত্র কফ ফেলা উচিত নয়।

যক্ষ্মা নিয়ে ভয় নেই : যক্ষ্মা হলেও আতঙ্কিত হবেন না।  আগে বলা হতো যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই। এখন বলা হচ্ছে, যক্ষ্মা ওষুধে ভালো হয়। যক্ষ্মা হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ছয় থেকে ৯ মাসের পূর্ণ ডোজ ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিনামূল্যে এই ওষুধ প্রদান করে থাকে। ওষুধ অনিয়মিত খেলে পরবর্তী সময়ে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা হতে পারে, যা সারানো খুব জটিল। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক বা হাসপাতাল, নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এনজিও ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে কফ পরীক্ষা, রোগ নির্ণয়সহ যক্ষ্মার চিকিৎসা করা হয় ও ওষুধ দেওয়া হয়। পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন করতে হবে। তাই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।

লেখক : বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, লালবাগ, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর