বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার চিকিৎসাবিষয়ক প্রচলিত ভ্রান্তিসমূহ

শামীম আহমেদ

করোনার চিকিৎসাবিষয়ক প্রচলিত ভ্রান্তিসমূহ

আইসিইউ না থাকলে বা ভেন্টিলেশন না থাকলেই যে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের কোনো কাজ নেই বা রোগীদেরও আর কোনো সাপোর্ট পাওয়ার সুযোগ নেই, ব্যাপারটা তেমন নয়

১) ভেন্টিলেটর কিংবা আইসিইউ বেড না থাকলে শুধু শুধু হাসপাতালে গিয়ে কী হবে?

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে, বাংলাদেশে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা খুব কম। আইসিইউ বেডও খুব বেশি নয়। করোনাভাইরাস জটিল আকার ধারণ করলে মানুষকে আইসিইউতে নিয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে কৃত্রিমভাবে নানা সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এখন যে দেশে ভেন্টিলেটর এত কম সে দেশে ডাক্তাররা হাসপাতালে নিলে কি আর করোনা রোগীদের কোনো সাহায্য করতে পারবে?

আসলে পারবে। এ ব্যাপারটিই জেনেছি নানা চিকিৎসক বন্ধু যারা সরাসরি দেশ-বিদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে। এক চিকিৎসক বন্ধু অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, তিনি দেখেছেন নিজে হেঁটে হাসপাতালে আসা এক রোগী যখন ইমার্জেন্সিতে, তখন তার শরীরে অক্সিজেন কনজাম্পশনের মাত্রা ৯৯% ছিল। অথচ মাত্র ৫ মিনিট পরেই সেটি কমে ৭০ ভাগের নিচে চলে যায়। এ রোগীকে পরবর্তীতে ভেন্টিলেটর ছাড়াই হাইপ্রেসার অক্সিজেন সরবরাহ এবং নিয়মিত চেকআপ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করে সুস্থ করা গেছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শতকরা ৮০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই ভেন্টিলেটর বা আইসিইউ বেডের দরকার হয় না। নিয়মিত চিকিৎসা, ওষুধ সরবরাহ ও হাইপ্রেসার অক্সিজেন দিয়ে তাদের সুস্থ করা যায়। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইসিইউতে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দেওয়া রোগীদের ৬৫ শতাংশই মারা গেছেন, সেখানে আইসিইউর বাইরে সাধারণ বেডে ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ রোগীকে হাইপ্রেসার অক্সিজেন ও অন্যান্য সাপোর্ট দিয়ে সুস্থ করা গেছে। তার মানে আইসিইউ না থাকলে বা ভেন্টিলেশন না থাকলেই যে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের কোনো কাজ নেই বা রোগীদেরও আর কোনো সাপোর্ট পাওয়ার সুযোগ নেই, ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে নিঃসন্দেহে ঘরে কোয়ারেন্টাইনে থেকে সুস্থ থাকতে পারাই এ সময়ে সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। উল্লেখ করা জরুরি যে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করার জন্য ডাক্তাররা হাসপাতালে অনেক কিছু করেন। ফুসফুস, শ্বাসযন্ত্র, কিডনিসহ নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গকে সুস্থ ও কার্যকরী রাখতে যেসব কাজ করা লাগে সেগুলো সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি বুঝিনি, তাই এখানে লিখিওনি। কিন্তু যে তথ্যগুলো জানা জরুরি তা হচ্ছে : ঘরে কোয়ারেন্টাইনে থেকে আক্রান্ত না হওয়াটাই সেরা সিদ্ধান্ত। করোনাতে আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগী শুধু ২ সপ্তাহ বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে যাবেন। এ ৮০ শতাংশের অনেকে জানবেনও না যে তাদের করোনা হয়েছিল। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে আশি শতাংশ যদি হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সের নিয়মিত সেবা পান, ওষুধ ও হাই ফ্লো অক্সিজেন পান, তাহলে সুস্থ হয়ে যাবেন। বাকি যে অল্প কিছু রোগী থাকবেন (বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে সেই অল্প রোগীর সংখ্যাও লক্ষাধিক হয়ে যেত পারে), তাদের ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ বেড অবশ্যই লাগবে। এবং আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর পাওয়ার পরও তাদের ন্যূনতম ৬৫ ভাগকেই হয়তো বাঁচানো যাবে না। (যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে আইসিইউতে রাখলেও কিন্তু ভেন্টিলেটর দেওয়া লাগেনি, হাই ফ্লো অক্সিজেন ও অন্যান্য সেবা দিয়েই তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন।)

২) কোয়ারেন্টাইন কিংবা আইসোলেশন কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। খুব পরিষ্কারভাবে জেনে রাখুন করোনাভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই। ভ্যাকসিন নেই, ওষুধ নেই, কিছুই নেই। যে হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো কোনোটিই করোনার জন্য নতুন আবিষ্কার হওয়া কোনো ব্যবস্থা নয়। এগুলো গত অর্ধ শতাব্দী ধরে সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনেক ছোঁয়াচে রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

কেউ প্রকাশ্যে বলছেন, কেউ বলছেন না। কিন্তু কোনো দেশই মনে করে না যে খুব সহসাই করোনার ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার হয়ে যাবে। পরীক্ষামূলক যেসব ওষুধের কথা আমরা শুনছি সেগুলো মূলত করোনার নানা উপসর্গ কমিয়ে নিয়ে আসার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশই বিশ্বাস করে, করোনা দূর হওয়ার জন্য মূলত পৃথিবীর ৮০ শতাংশ মানুষকে একবার হলেও করোনা আক্রান্ত হতে হবে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, সবাইকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দিলেই তো অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সবাই আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থও হয়ে যেতে পারে, তাহলে ল্যাঠা চুকে যায়। এত কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন ইত্যাদি করে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার দরকারটা কী? দরকার আছে। কারণ করোনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষরাই মূলত বেশি আক্রান্ত হন, মৃত্যুর হারও প্রায় ৯৫ শতাংশই তাদের মধ্যে। এর নিচে অল্প কিছু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার খুবই কম। এখন দেশগুলো যদি কোনো ব্যবস্থা না হয় তাহলে একবারে সবাই অসুস্থ হলে লাখ লাখ বয়স্ক মানুষের আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, হাসপাতালে সাধারণ বেড লাগবে, অক্সিজেন লাগবে, ওষুধ লাগবে, ডাক্তার লাগবে- যেটা পৃথিবীর কোনো দেশেরই নেই।

কিন্তু কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও লকডাউনের মাধ্যমে যদি এ আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটাকে ন্যূনতম ৬ মাসে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে সব দেশই তাদের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে কিছুটা হলেও চিকিৎসাসেবা দিতে পারবে, নাহলে শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়তে পারে। তার মানে হচ্ছে এ বিদ্যমান পদ্ধতি করোনাকে প্রতিরোধ করার জন্য নয়, বরং করোনাকে ধীরে ধীরে সামলানোর একটি বিশেষ সামাজিক ও আচরণগত রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি। তাই আরও দীর্ঘদিন  সতর্কতা মেনে চলতে হবে।

৩) মানুষজন হাটবাজারে গেলে তাহলে আর এখন লকডাউন জারি রেখে কোনো লাভ আছে?

আছে ভাই আছে। আপনি যদি ১৭ কোটি মানুষকেই টানা ১৪ থেকে ২১ দিন বাসায় আটকে রাখতে পারতেন, তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত আপনি করোনাকে প্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তাও পুরোপুরি পারতেন না, সীমান্তে আনাগোনা থাকে, পণ্যের চলাচল হয়। কিন্তু এই যে সাম্প্রতিক হাজার হাজার মানুষ বাজারে যাচ্ছে তাতে করে অবশ্যই লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু তবু যতটা লকডাউন সম্ভব হচ্ছে, তাতেও কাজ কম হচ্ছে না।

৪) একবার করোনা হলে বললেন যে আর হয় না, কিন্তু অমুক অমুক জায়গায় পড়লাম তমুক আপার নাকি আবার হইছে?

এটা নিয়েও নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত আশাবাদী যে একবার যার করোনা হবে তার দ্বিতীয়বার হবে না। কিছুক্ষেত্রে দেখা গেছে কারও কারও নাকি দ্বিতীয়বার করোনা হয়েছে, কিন্তু তারা কেউ মারা গেছেন, এমন তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যাদের দ্বিতীয়বার করোনা ধরা পড়েছে, তাদের প্রথমবারের টেস্টটা ঠিকমতো করা হয়েছিল কিনা এটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা সন্দিহান। ডাক্তাররা বলছেন, এমন হতে পারে প্রথমবার টেস্টে যদিও দেখা গেছে তাদের করোনা ছিল, আসলে তাদের হয়তো করোনা ছিলই না, ভুল টেস্ট রিপোর্ট এসেছিল। প্রতি ১০০ জনের টেস্টে এমন ৫ শতাংশ ফলস পজিটিভ (অর্থাৎ করোনা নেই, কিন্তু ধরা পড়েছে আছে) অথবা ফলস নেগেটিভ (অর্থাৎ করোনা আছে কিন্তু ধরা পড়েনি) হতে পারে। তারা ধারণা করছেন দ্বিতীয়বার করোনা ধরা পড়া কেসগুলো মূলত এমন।

ডাক্তাররা বলছেন, করোনার ক্ষেত্রে আসলে প্রথম টেস্টের ৪৮ ঘণ্টা পর আবার টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া গেলে খুব ভালো হতো, কিন্তু মহামারীর বর্তমানে এমন অবস্থা, যাদের একবার দরকার, তাদেরই করা যাচ্ছে না। সুতরাং কারও দ্বিতীয়বার করার মতো অবস্থা নেই। সুতরাং আমরা এখন পর্যন্ত আশা করতে পারি করোনা একবার হলে হয়তো আর না-ও হতে পারে। এ ভুল রেজাল্টের কারণেই বেশিরভাগ উন্নত দেশই র‌্যাপিড টেস্টে বিশ্বাস করে না। র‌্যাপিড টেস্টে ফলস নেগেটিভের হার ১৫ শতাংশেরও বেশি, যেটি মহামারীর ক্ষেত্রে আত্মঘাতী। তাই র‌্যাপিড টেস্টের ব্যবহার সীমিত রাখা জরুরি।

এটি একটি নতুন রোগ। শতবর্ষের প্রথম মহামারী। আমরাও শিখছি।  এগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখনই সময় সামাজিক সংযোগ ও আচরণে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর (দূরত্ব বজায় রেখে)। তাই এ বিষয়ে সচেতন হোন।

লেখক : সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ার হেলথ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো।

সর্বশেষ খবর