রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা
প্রেসক্রিপশন

সুস্থ ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

সুস্থ ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা

ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ রমজানের রোজা। শুধু আত্মশুদ্ধিরই নয়, এ মাস আত্মনিয়ন্ত্রণেরও। এবারের রমজান মাসটা ভিন্ন পরিবেশে পালিত হচ্ছে। গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কবলে রয়েছে। তাই এবারের রোজায় মানুষের জীবনযাত্রা কিছুটা পাল্টে গেছে। রোজা রাখলে অনেকে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় করেন, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে রোজায় কারও স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে বা রোজা রেখে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে এমন কোনো ঘটনার কথা শোনা যায়নি। রোজা কষ্টকর ইবাদত এবং রোজার দ্বারা শরীরে চাপ পড়ে বলে অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রোজা পরিত্যাগ করা সম্পূর্ণ অনুচিত। রোজা রাখায় প্রাণের আশঙ্কা আছে এ কথাটি কোনো আলেম এবং ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। গর্ভবতী মহিলার যদি গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা হয় অথবা স্তন্যদায়ী মা যদি রোজা দ্বারা তার নিজের বা তার স্তন্যপানকারী শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তবে সেও এই মাসে রোজা না রেখে পরে সুবিধামতো সময়ে কাজা আদায় করতে পারে। অনেক রোগীই যে কোনো অবস্থায় রোজা রাখতে বদ্ধপরিকর। আবার অনেকেই নিজের মতো অজুহাত তৈরি করে রোজা না রাখার যুক্তি খোঁজেন। আসলে দীর্ঘস্থায়ী রোগেও রোজা রাখা সম্ভব। রোজার মাসে পেপটিক আলসার রোগীরা খালি পেটে থাকবেন, ডায়াবেটিস রোগীরা কীভাবে রোজা রেখে ইনসুলিন নেবেন, উচ্চরক্তচাপের রোগীরা কীভাবে দুই বা তিনবেলা ওষুধ সেবন করবেন এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। আবার কিছু কিছু অসুস্থ ব্যক্তি এমনকি সুস্থ ব্যক্তিও দুর্বলতা এবং নানারকম দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার কারণে রোজা রাখতে গড়িমসি করেন। আসলে রোজা রাখলে শরীরে তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুচিন্তিত অভিমত হলো, রোজা স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তো করেই না বরং শরীর ও মনের উন্নতি লাভে সহায়ক। পেপটিক আলসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগী, বাত ব্যথার রোগীরাও সরাসরি রোজায় উপকার পান। পেপটিক আলসারের কারণে অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, পেপটিক আলসারে রোজা বিশেষ উপকারী। মানুষের পেটই হলো সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। পেট ঠিক থাকলে সব কিছু ঠিক থাকে। আর পেটে সমস্যা দেখা দিলে স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। সারা বছরে একবার পেটের নিষ্কাশন প্রয়োজন। এক মাস সিয়াম পালন করলে উত্তম রূপে পেটের দূষিত ক্ষতিকর পদার্থের নিষ্কাশন ঘটে। পাকস্থলীতে এক ধরনের উপকারী জীবাণু খাদ্য হজমে সাহায্য করে। বছরের ১১ মাস এসব জীবাণু অনবরত খাদ্য হজমের কাজে লিপ্ত থাকার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ এক মাস রোজার ফলে এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য জীবাণুগুলো বিশ্রাম পায়। বিশ্রামের ফলে এরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে বাকি ১১ মাস আবার খাদ্য হজমে ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে। মানবদেহে চর্বি ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে হৃদরোগ, রক্তচাপ, বহুমূত্র রোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। রোজা চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে নিরাপদ রাখে। রোজা মস্তিষ্কের কার্যক্রম সুষমভাবে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিক খাদ্য গ্রহণে শরীরের ওপর যেমন চাপ বৃদ্ধি পায় তেমনি এই চাপ মস্তিষ্কের ওপরও পড়ে। এ জন্যই বলা হয় ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের আধার। রোজায় শরীরের প্রোটিনফ্যাট ও শর্করা স্বয়ং পরিচালিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলো পুষ্টি পায়। ফলে শরীরে উৎপন্ন সূচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এ পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে। রোজায় শরীরের ক্ষতিকারক টক্সিনের মাত্রা কমে যায়। রোজা অবস্থায় কিডনি ও লিভার বিশ্রাম পায়। কিডনির মাধ্যমে শরীরে প্রতি মিনিটে ১ থেকে ৩ লিটার রক্ত সঞ্চালিত হয়। অপ্রয়োজনীয় পদার্থগুলো প্রশ্রাবের সঙ্গে নির্গমন হয়। সুস্থ রোগীর লিভার আরও সুষ্ঠুভাবে কার্যক্ষম হয়। তবে লিভারে বা কিডনিতে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার দৈহিক গঠন প্রকৃতি ও স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে। কিন্তু এর কাজের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। সাধারণত সারা বছর এগুলো ন্যূনতম বিশ্রামের সুযোগও পায় না। কিন্তু রোজায় শরীরের

সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দৈনিক প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পায়। ফলে পরবর্তী সময়ে এগুলো আরও শক্তি নিয়ে সুন্দরভাবে মানবদেহে কাজ করতে পারে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থতার পাশাপাশি রোজায় মানসিক শক্তি, স্মরণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তিসহ সব কিছুই বৃদ্ধি পায়।

সব মিলিয়ে রোজা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর