শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা
করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পদ্ধতি

সোয়াব বনাম রক্ত পরীক্ষা

সেরীন ফেরদৌস

সোয়াব বনাম রক্ত পরীক্ষা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকেই মানুষের শরীরে ভাইরাসের প্রবেশ ঘটেছে কি না তা শনাক্ত করতে সোয়াবের মাধ্যমে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সোয়াব টেস্টের মাধ্যমে জানা সম্ভব যে মানুষটি আক্রান্ত হয়েছে! এমনকি সিমটম (জ্বর, কাশি, হাঁচি, ক্লান্তি, ডায়রিয়া ইত্যাদি) শুরু হওয়ার আগেই সেটা জানা সম্ভব। এখন পর্যন্ত সিংহভাগ দেশই এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সম্প্রতি কানাডা অতিদ্রুত, ঘণ্টা দুয়েকের ভিতরই, সোয়াব পরীক্ষার পোর্টেবল ডিভাইস চালু করেছে। ভাইরাসের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ এবং বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো ‘র‌্যাপিড টেস্টে’র পদ্ধতি উদ্ভাবন করে যা কণ্ঠের লালাজাতীয় পদার্থে নয়, রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করে। এই পদ্ধতিতে দ্রুত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করা যায় বলে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭০টিরও বেশি কোম্পানি তড়িঘড়ি করে র‌্যাপিড টেস্টের কিট প্রস্তুত শুরু করলে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। তারা অননুমোদিত টেস্টিং কিটের ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে রক্ত পরীক্ষা পদ্ধতি (এন্টিবডি/ এন্টিজেন) কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সোয়াবের মাধ্যমে এবং রক্ত থেকে করোনা টেস্টের পরীক্ষা কীভাবে করা হয় তা নিয়ে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করার দরকার পড়ে যাতে রোগীকে দ্রুত অন্যদের থেকে আলাদা করে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তার মাধ্যমে আর কেউ যাতে সংক্রমিত না হন সেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। করোনাভাইরাস এতই ক্ষুদ্র যে, একটি কোষও তার চেয়ে বহুগুণে বড়! ভাইরাসটি একটি মাত্র প্রোটিন (আরএনএ) দিয়ে তৈরি। এ জন্য এটি পরীক্ষার জন্যও অত্যন্ত দক্ষ ও তুলনামূলক শুদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করার প্রযোজনীয়তা রয়েছে। ভাইরাসটি (এন্টিজেন) একজন মানুষের নাক-মুখ-গলায় প্রবেশের আরও অনেক অনেক পরে রক্তে যায়। ভাইরাসের সংক্রমণের পর শরীরে এন্টিবডি তৈরি হতেও গড়ে দু-এক সপ্তাহ সময় নেয়। বলাবাহুল্য, এন্টিবডি রক্তেরই একটি উপাদান মাত্র। এন্টিবডি তৈরি হতে কার কতদিন সময় লাগবে এবং কি পরিমাণে তৈরি হবে, তা নির্ভর করে রোগীর বয়স এবং শরীরের সামর্থ্যরে ওপর। কারও কারও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরপরই রক্তে এন্টিজেন ও এন্টিবডি, এই দুই বান্দার কাউকেই পাওয়া যায় না! এখন আমাদের শরীরে ভাইরাস ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই, গলায় ও নাকের ভিতরে থাকা অবস্থায়ই যদি সেটিকে শনাক্ত করা যায়, তবে রোগীকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। শুরুতেই তাকে আলাদা করে ফেলার মাধ্যমে মারাত্মক ছোঁয়াচে এ দুশমনকে আশপাশের অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া রোধ করা যায়। ভাইরাসটির রক্তে পৌঁছতে পৌঁছতে যেটুকু সময় লাগে, সে-পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর যদি কারও পরীক্ষা করা হয়, দেখা যাবে ততদিনে রোগী নানারকম সিম্পটম ভোগ করছে অথবা রোগীর অসতর্ক থাকার সম্ভাবনা থাকছে এবং এমনকি গুরুত্ব কম দেওয়ার কারণে মৃত্যুও ঘটতে পারে! এই সময়ে সে আরও মানুষকে সংক্রমিতও করে ফেলতে পারে। এ জন্যই সোয়াব টেস্টকে বলা হয় সরাসরি পদ্ধতি আর রক্ত পরীক্ষাকে বলা হয় পরোক্ষ পদ্ধতি। অর্থাৎ ততদিনে ব্যক্তির ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়ে যায়। আর হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হওয়া ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষে সীমিত আকারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত থাকে। হার্ড ইমিউনিটির মানুষের রক্ত নিয়ে অবশ্য প্লাজমাথেরাপি বা অন্যান্য ভ্যাকসিন সম্পর্কিত গবেষণায় কাজে লাগানোর সম্ভাবনা থাকে। আরও কথা আছে। যেহেতু এন্টিবডি তৈরি হতে সময় লাগে এবং রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার পরও এন্টিবডি রক্তে থেকেই যায়, তাই শুধু এন্টিবডি পরীক্ষা করে কাউকে ‘রোগী’ সাব্যাস্ত করা ১০০% ঠিক বলা যায় না। আবার করোনাভাইরাস ছাড়াও অন্য কোনো কারণে (সাধারণ ফ্লু) শরীরে আগে থেকেই বেশি পরিমাণে এন্টিবডি তৈরি হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রেও রক্তে এন্টিবডির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে করোনা-আক্রান্ত নয় এমন কাউকেও ভুলক্রমে করোনা-আক্রান্ত বলে নির্বাচন করা হতে পারে। সোয়াব টেস্ট করা হয় নাক ও গলার ভিতরের দিকে তুলার কাঠি ঢুকিয়ে লালামতো জিনিস এনে পরীক্ষা করে। ওই লালাতে ভাইরাসের প্রোটিনটি থাকে। সোয়াব বা পিসিআর পদ্ধতিতে ভাইরাসের জেনেটিক উপদানের অংশবিশেষ আলাদা করে সেগুলো অসংখ্যবার কপি করা হয়। তারপর নিশ্চিত করে বলা হয় যে এটি করোনাভাইরাস। তবে স্যাম্পল নেওয়ার বেলায় দক্ষতার দরকার আছে। আগে কয়েক দিন সময় লাগলেও এখন দ্রুত করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাইরাসটি নাক এবং মুখ দিয়ে ঢোকার পর প্রথমে নাকের ভিতরে এবং গলায় বাসা বাঁধে। তারপর ফুসফুসে যায় ও আক্রান্ত করে। ফুসফুসের ছোট ছোট অক্সিজেন বহনকারী বলগুলোর কোষে ঢুকে বিলিয়ন বিলিয়ন নতুন ভাইরাস তৈরি করে ও কোষগুলো নষ্ট করতে থাকে। ইমিউন সিস্টেম তখন ভাইরাসটিকে একটি অপরিচিত প্রোটিন বা শত্রু-এন্টিজেন হিসেবে শনাক্ত করে এবং দ্রুত শরীরকে জানান দিতে থাকে যে ‘বাইরের শত্রু’ এসেছে! এ অবস্থায় রোগী কাশবে, জ্বর আসবে, হাঁচি দেবে, ডায়রিয়া ইত্যাদি হবে অর্থাৎ শরীর জানবে যে সে আক্রান্ত! একে বলা হয় তাৎক্ষণিক ইমিউন রেসপন্স! এই সময়কালে কভিড-১৯ রোগীর চারদিকে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ভাইরাসটি যতক্ষণ পর্যন্ত ফুসফুসে আটকা থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আক্রমণকে ‘লোকাল ইনফেকশন’ নামে পরিচিত। তারপর ধীরে ধীরে ভাইরাসটি অন্যান্য প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফুসফুস ছেদ করে রক্তে প্রবেশ করে। তখন তাকে ‘জেনারেল ইনফেকশন’ বা সেপসিস বলে। রোগটি এতদূর গড়িয়ে গেলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনাও কমে আসে। লোকাল ইনফেকশন থাকা অবস্থায়ই শরীরের ইমিউন সিস্টেম এন্টিবডি তৈরিতে মনোযোগ দেয়। কখনো তা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগে। রক্তের মাধ্যমে যে পরীক্ষা পদ্ধতি তাতে কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভাইরাসটি ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রক্ত পর্যন্ত যেতে হবে। ভাইরাসটি রক্তে যাওয়ার পরই এই ধরনের পরীক্ষায় ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসাকেন্দ্রে বা চিকিৎসার জন্য করোনায় পরীক্ষায় এই ধরনের এন্টিবডি বা রক্তের মাধ্যমে পরীক্ষাকে সমর্থন দিচ্ছে না। গত ৮ এপ্রিল তারা এক বিবৃতিতে বলে দিয়েছে তারা এন্টিজেন চিহ্নিত করণের মাধ্যমে র‌্যাপিড টেস্টকে সুপারিশ করে না। তবে গবেষণা বা এই টেস্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধি বা মানোন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

লেখক : কমিউনিটি নার্স, কানাডা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর