সোমবার, ৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালে রোজায় খাদ্যাভ্যাস

জেনিফার বিনতে হক, পুষ্টিবিদ

করোনাকালে রোজায় খাদ্যাভ্যাস
এবার যেহেতু ১৪-১৫ ঘণ্টার রোজা রাখতে হবে তাই খাদ্য তালিকায় ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত বয়স, ওজন ও উচ্চতা ভেদে ৮-১২ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন। তাছাড়াও তাজা ফলের রসের শরবত রাখা যেতে পারে

পবিত্র রমজান মাসের রোজাগুলো পালন করার সময় অন্যবারের তুলনায় এবার মানতে হবে আরও বাড়তি সতর্কতা। কেননা এখন আমাদের দেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে করোনার বিস্তার। তাই এবারের রোজায় খাদ্য পরিকল্পনা করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে বিশেষ কিছু বিষয়-

* রোজায় এবার অতিরিক্ত আইটেম না রেখে সংক্ষিপ্ত আইটেম রাখুন। বার বার বাজার যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। খাদ্য অপচয় করা থেকে বিরত থাকুন। সহজে হজম হয় এবং পুষ্টি যেন যথাযথ পূরণ হয় এবং দামেও সাশ্রয়ী এমন খাবার নির্বাচন করুন।

* প্রতি বছর রোজায় মাত্রাতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে বমি, ডায়রিয়া, বদহজম, কোষ্ঠা কাঠিন্য, বুক জ্বালাপোড়া ইত্যাদি রোগে মানুষ ভোগে। মনে রাখতে হবে, এবার আমাদের অতিভোজনের ফলে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতা থেকে সাবধান থাকতে হবে যেন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হুমকির মুখে না পড়ে তাই অতিভোজন এড়িয়ে চলুন।

* এই রোজার সময়ও করোনা মোকাবিলায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য যেসব খাবার নির্বাচন করবেন সেগুলোর উৎস যেন প্রোটিন সমৃদ্ধ হয়, বিটা ক্যারোটিনযুক্ত, ভিটামিন সি, ই, ডি, বি৬, সেলেনিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামযুক্ত হয়। তাছাড়াও রোজায় দৈনিক খাবারগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে খেতে হয়। ইফতার, সন্ধ্যা রাতের খাবার ও সাহরি। তাই পুষ্টিঘাটতি রোধে কোনো বেলার খাবার কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না।

* বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে বারবার পর্যাপ্ত পানি এবং পানীয় গ্রহণ করতে। তাই এবার যেহেতু ১৪-১৫ ঘণ্টার রোজা রাখতে হবে তাই খাদ্য তালিকায় ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত বয়স, ওজন ও উচ্চতা ভেদে ৮-১২ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন। তাছাড়াও তাজা ফলের রসের শরবত রাখা যেতে পারে যা থেকে ভিটামিন সি এবং এ-সহ প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেলস পাওয়া যাবে। বাইরের কমার্শিয়াল ফলের জুস এড়িয়ে চলুন। ডায়াবেটিসের রোগীরা মিষ্টি ফলের রস এড়িয়ে চলুন, তারা রাখতে পারেন টকদইয়ের লাচ্ছি, ইসবগুলের ভুসি, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, স্যুপ ইত্যাদি। এমনকি যাদের ডায়াবেটিস নেই তারাও এগুলো পানীয় হিসেবে খেলে পাবেন প্রচুর পুষ্টি।

* ইফতারে রাখুন বিভিন্ন ফল যথা আম, মাল্টা, ডালিম, জাম্বুরা, কলা, তরমুজ ইত্যাদি। তা ছাড়াও এই ফলগুলোর সঙ্গে টকদই মিশিয়ে ফলের সালাদ বানিয়ে খেলে সালাদটি প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ হবে তাছাড়া দইয়ের থেকে পাওয়া যাবে প্রোবায়োটিকস ও প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি-যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বাড়াবেই, সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে প্রচুর আঁশ যা কোষ্ঠ পরিষ্কার করতে খুবই সাহায্য করে। অন্তত দিনে দুই কাপ মিশ্র ফল রাখা প্রয়োজন। ইফতারিতে দুই পিস খেজুর আপনার সারা দিনের রোজার শেষে দ্রুত শক্তি জোগাবে।

* প্রত্যেক ব্যক্তির তার নির্দিষ্ট ক্যালরির মাত্রা ঠিক রেখে খাদ্য নির্বাচন ও গ্রহণ করতে হবে। রোজার মেন্যু হিসেবে এমনভাবে খাবার নির্বাচন করুন যেন সেই একটা খাবার থেকে পরিপূর্ণ পুষ্টিও পাওয়া যাবে এবং খাবারটিও হবে সুষম কারণ এখন অনেক বাসায় সাহায্যকারী নেই তাই অনেক খাদ্য আইটেম করতে গিয়ে খরচ ও শ্রম নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন। ইফতার, সন্ধ্যা রাতের খাবার এবং সাহরির খাবারে কী ধরনের মেন্যু রাখা যেতে পারে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হলো- # ইফতারিতে মুড়ি-কম তেলে তৈরি অঙ্কুরিত ছোলা-সালাদ/কয়েক রকমের ডাল মিশ্রিত সবজি খিচুড়ি/রুটি-মুরগি-সবজি/দুধ-সাগু-ফল/ওটস-দুধ-বাদাম/মুরগি-নুডলস-সবজি/মুরগি-সবজির স্যুপ/দই-চিঁড়া-কলা ইত্যাদি রাখতে পারেন। এসব খাবারের প্রতিটিতেই মৌলিক খাদ্যগোষ্ঠীর প্রায় সব পুষ্টি উপাদানের চাহিদাই পূরণ করা সম্ভব এবং গ্যাসের সমস্যাও এড়ানো যাবে। গতানুগতিক বেগুনি, পিয়াজু, চপ, অতিরিক্ত ঝাল মসলাযুক্ত ছোলা ইত্যাদি যতটা পারেন কম খাবেন। যদি ভাজা খাবার খেতেই হয় তাহলে খুব কম তেলে তৈরি করতে হবে তবে তা সপ্তাহে এক/দুবারের বেশি নয়। প্রসেসড ফুড, জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড, ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে।

# রাতের খাবার কোনো অবস্থাতেই বাদ দেওয়া যাবে না। মেন্যু হতে পারে লাল চালের রুটি বা ভাত-মুরগি বা মাছ-সবজি-পাতলা ডাল ও সালাদ। যেদিন ইফতারে বেশি খাওয়া হয়ে যাবে সে দিন রাতের খাবার হালকা রাখুন। যথা : দুধ-মুড়ি, স্যুপ-সবজি, নুডলস, কর্ন ফ্লেক্স-দুধ ইত্যাদি।

# সাহরিটা হতে হবে সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত এবং খেতে হবে আজান দেওয়ার আগে শেষ সময় পর্যন্ত। এতে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কম হবে। খাবারটি এমন হতে হবে তা যেন আপনাকে সারা দিন শক্তি জোগাবে এবং পুষ্টিগুণে সুষম। তাই সাহরি খেতে হবে ভালোমতো। ভাত-মাছ বা মুরগি-সবজি রাখতে পারেন বা দুধ-কলা ভাত/দুধ-ওটস-খেজুর বা দুধ-কর্নফ্লেক্স-বাদাম রাখতে পারেন। যাই খাবেন, ভাজা পোড়া এবং অধিক মসলাযুক্ত খাবার যেন না হয়।

* কিছু রিহাইড্রেটিং খাবার আছে যা এই রোজায় পানিশূন্যতা দূর করে যথা-শসা, টমেটো, তরমুজ, লেটুস, পালং শাক, কমলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি। এগুলোকে রোজার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।

* যাদের জন্য মাছ বা মুরগির মতো প্রোটিন কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে তারা তাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে উৎস হিসেবে বেছে নিতে পারেন বিভিন্ন ধরনের ডাল, বাদাম এবং বিচি জাতীয় খাবার। তা ছাড়া ডিমও হতে পারে প্রোটিনের চাহিদা পূরণের খুবই ভালো উৎস। * বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার যথা জিলাপি, ডেজার্ট, পাই, মিষ্টি ইত্যাদি বর্জন করুন। কারণ অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার আমাদের দেহে পানির চাহিদা বাড়ায় আর স্থূলতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।

* অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার যথা-আচার, চিপস, পাতে কাঁচা লবণ এড়িয়ে চলুন। কারণ এগুলো শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি করে এবং উচ্চরক্তচাপ রোগীদের জন্যও লবণাক্ত খাবার খুবই ক্ষতিকর।

* চা, কফি, কোমল পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এগুলো ডাই-ইউরেটিক্স হিসেবে কাজ করে এবং প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেহ পানিশূন্য হয়ে পড়ে। খেতে চাইলে হালকা লিকার চা, লেবু চা, আদা চা, গ্রিন-টি অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। কারণ এগুলোর এন্টি-অক্সিডেন্ট ও এন্টি ইনফ্ল্যামাটিরি উপাদানগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। তাই এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে যত্নবান হতে হবে। মনে রাখবেন প্রতিকার নয় প্রতিরোধ উত্তম।

লেখক : পুষ্টি বিশেষজ্ঞ।

সর্বশেষ খবর