মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

উপসর্গবিহীন করোনা সংক্রমণ সমাধান কোনপথে?

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

উপসর্গবিহীন করোনা সংক্রমণ সমাধান কোনপথে?

আর কতদিন চলবে করোনা মহামারীর এই  তান্ডবলীলা? চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে গত ডিসেম্বর মাসে সেই যে শুরু, এরপর মাত্র চার মাস কাল সময়ের মধ্যে এই ব্যাধি প্রায় সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, আক্রান্ত করেছে প্রায় ৩৫ লক্ষাধিক মানুষকে আর দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর কোলে। বিশেষ করে, ইউরোপ-আমেরিকার অর্থ-বিত্তে মহীয়ান-গরীয়ান দেশসমূহে। যদিও প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে, সাউথ এশিয়ায় এখনো পর্যন্ত করোনার বিস্তার আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা নিম্নমার্গে আছে।  কেমন যাবে সামনের দিনগুলো? ব্যাপকভাবে আক্রান্ত দেশগুলোর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ের পর এক থেকে দেড় মাসের মাথায় আক্রান্তের সংখ্যায় ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটেছে। সেই হিসেবে এখন থেকে শুরু করে আগামী এক মাস আমাদের জন্য শেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞের একটি প্যানেল আগামী দিনের করোনা সংক্রমণের গতি-প্রকৃতির ওপর দুটি projection তৈরি করেছেন। অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল projection টি হলো : চলতি বছরের ৩১ মে নাগাদ ৪৮-৫০ হাজার ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হতে পারে এবং মৃত্যু হতে পারে ৮০০-১০০০। দ্বিতীয় projection অনুসারে, প্রায় এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। আগামী এক মাসে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ যদি আক্রান্ত হয়, তাদের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা দানের জন্য যে অবকাঠামো ও জনবল দরকার তা কি আমাদের আছে? এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টেস্ট করে প্রায় ছয় হাজার ব্যক্তি অর্থাৎ মোট টেস্টের ১২% Covid-19 +ve পাওয়া গেছে। এ হিসেবে আগামী এক মাসে ৫০ হাজার মানুষকে Covid-19 +ve রূপে শনাক্ত করতে হলে চার লাখের ওপর অর্থাৎ দৈনিক প্রায় ১৩ হাজার টেস্ট করতে হবে। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১৫%-এর মারাত্মক সংক্রমণ থাকে, ৫%-এর অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। তার মানে, এক লাখ লোক আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আমাদের ১৫ হাজার হাসপাতাল শয্যা এবং পাঁচ হাজার ICU বেড লাগবে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের চিকিৎসা সামর্থ্যরে বিচারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধই একমাত্র বিকল্প। এজন্য আমরা social distancing-এর ওপর গুরুত্বারোপ করছি এবং আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী করোনার উপসর্গ দেখা যাচ্ছে এমন ব্যক্তিদের test-এর আওতায় আনছি। উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সংক্রমিত ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কোনো উপসর্গ থাকে না। আইসল্যান্ডে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১০% জনগণের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেকের মধ্যে কোনো ধরনের উপসর্গ ছিল না। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের ০৮ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের এক প্রতিবেদন চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের বরাতে জানায়, ৩১ মার্চ থেকে ০৭ এপ্রিলের মধ্যে শনাক্তকৃত ৮৮৫ জন Covid-19 +ve রোগীর মধ্যে ৬০১ জনের অর্থাৎ ৬৮% -এর কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ ছিল না। US Centers for Disease Control and Prevention (CDR)-এর পরিচালক ড. রবার্ট রেডফিল্ড এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উপসর্গবিহীন থাকে। এ সংখ্যাটি ২৫%-এর মতো হতে পারে (NPR, 31 March 2020)| Indian Council of Medical Research (ICMR)-এর প্রধান ড. আর গঙ্গাখেদকার বলেন, ১০০ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ৮০ জনের কোনো উপসর্গ থাকে না কিংবা কেবল মৃদু উপসর্গ থাকে (India Today, 20 April, 2020। পত্রিকায় প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশেও এমন অনেক লোক Covid-19 +ve প্রমাণিত হয়েছেন, যাদের কোনো উপসর্গ ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের উপসর্গবিহীন করোনা বাহকেরা করোনা মোকাবিলায় আমাদের চলমান প্রচেষ্টায় কতটুকু চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এরা কি silent spreader হিসেবে রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে? প্রথম দিকে এমনটা ঘটছে না বলে মনে করা হলেও বিজ্ঞানীরা এখন জোরালোভাবে বিশ্বাস করছেন, উপসর্গবিহীন বাহকরা করোনা সংক্রমণে ভূমিকা রাখছেন। Journal of the American Medical Association (JAMA)-এ প্রকাশিত এক কেস স্টাডি অনুযায়ী, উহানের ২০ বছর বয়সী এক তরুণী উহান থেকে ৬৭৫ কিমি দূরে আনইয়াংয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে তার সংস্পর্শে এসে ওই পরিবারের পাঁচ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হন, অথচ ওই তরুণীর কোনো উপসর্গ ছিল না (JAMA, 21 February 2020)। আমেরিকান সংবাদ সংস্থা সিএনএন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেন, যদিও আমরা ঠিক জানি না উপসর্গযুক্ত ও উপসর্গবিহীন ব্যক্তিদের কে কত শতাংশ দায়ী, এখন এটা স্পষ্ট যে, উপসর্গবিহীন ব্যক্তিরা সংক্রমণ ছড়াতে আগে যেটুকু ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের Center for Infectious Disease Research and Policy-এর পরিচালক মাইকেল অস্টারহোমের ভাষায় : ‘আমরা এখন জানি, উপসর্গবিহীন সংক্রমণ এ রোগ ছড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা আছে।’ তিনি আরও বলেন, এটা একেবারেই পরিষ্কার যে, এরূপ সংক্রমণ এ ধরনের মহামারীকে এমন একটি মাত্রা দিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়বে (CNN health, 19 March 2020)। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের Public Health Laboratory Sciences Division-এর প্রধান লিউ পুন লিট-ম্যান বলেন, এসব asymptomatic (উপসর্গবিহীন) লোক presymptomatic (প্রাক-উপসর্গধারী) হতে পারে এবং কোনো রকম উপসর্গ প্রকাশ না পাওয়া সত্ত্বেও ভাইরাসটি তাদের কাছ থেকে অন্যের দেহে ছড়াতে পারে (South China Morning Post, 08 April 2020)। একই রকম অভিমত দিয়ে সম্প্রতি একদল চীনা গবেষক বলেন, যেহেতু কিছু সংক্রমিত লোকের মধ্যে কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না এবং তারা নীরবে এ রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছেন, সে কারণে এ রোগের সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন (Bloomberg News, 28 April 2020)। এভাবে ক্রমশ বিশ্বময় একটি অভিন্ন ধারণা গড়ে উঠছে, এ ভাইরাস কখনই পুরোপুরি নির্মূল হবে না, এটা ‘ফ্লু’র মতো সময়ে সময়ে ঘুরে ফিরে আসতে থাকবে। স্পষ্টতই উপসর্গবিহীন বাহকদের মাধ্যমে সংক্রমণের বিষয়টি চলমান করোনা মহামারীর সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লকডাউনের মাধ্যমে আপাতত নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও লকডাউন যখন উঠে যাবে এসব নীরব বাহকেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করবে।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।

সর্বশেষ খবর