বুধবার, ১৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় বস্তিবাসীর দুর্ভোগ ও আমাদের করণীয়

বেতন নিশ্চিত করার মাধ্যমে, বড় অংশের মানুষকে ঘরে রাখা যেতে পারে যা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। অনেক বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তি দরিদ্র জনগণকে সহায়তা করছে

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

করোনায় বস্তিবাসীর দুর্ভোগ ও আমাদের করণীয়

কভিড-১৯ মহামারীর ফলে বিশ্বব্যাপী সরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অবিশ্বাস্য লকডাউনের প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যে লকডাউনের মধ্যে অপরিসীম দারিদ্র্য সহ্য করছে এবং এর প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য বিস্তারের আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন জীবনযাপন করছে। শহরের গৃহহীন এবং বস্তিবাসী মানুষ যারা ‘শহুরে দরিদ্র’ হিসেবে অনধিক পরিচিত তারা লকডাউনের সময় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। বস্তিবাসীদের পাশাপাশি, শহরগুলোতে একটি বিশাল সংখ্যার ভাসমান জনগোষ্ঠী বাস করে, যারা বেশির ভাগ ভিক্ষাবৃত্তি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। এই জনগোষ্ঠী কভিড-১৯ এর লকডাউনের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব এবং নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহার সম্পর্কে কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই বাইরে বের হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে।

ঢাকা শহরে প্রায় ৩৫% মানুষ বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে, অপর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ এবং বিদ্যুতের সংযোগ ছাড়াই বসবাস করে। বস্তির মানুষেরা মূলত দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গার্মেন্ট কর্মচারী এবং গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। যারা প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। কভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বার বার সামাজিক দূরত্ব ও নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চিত করা এবং কিছুক্ষণ পর পর হাত ধোয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু জনবহুল বস্তিবাসীর পক্ষে ‘দুই মিটার দূরত্ব বিধি’ মেনে জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, ওয়াসা কিংবা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্যানিটেশন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং, সবার মধ্যে একটি প্রশ্ন, বস্তিতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা আদৌও কি সম্ভব বা এই মহামারী চলাকালীন বস্তিবাসী কীভাবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে জীবিকা নির্বাহ করবে? তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠী বস্তিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপায় খুঁজে বের করার জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারের কাজ করা উচিত। সামাজিক, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বস্তিবাসী সামাজিক দূরত্বের নীতি অনুসরণ না করেই ত্রাণ ও সহায়তার সন্ধানে রাস্তায় নেমে পড়েছে। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি কীভাবে বিভিন্ন স্থানে মানুষ ত্রাণসামগ্রী ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এটি তাদের জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক। যেহেতু তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ-উপার্জন করতে পারছে না, ফলে এই জাতীয় অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় আমরা বস্তিবাসীকে বলতে দেখেছি, তারা এখন উভয় সংকটে রয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে বস্তিতে থাকলে না খেয়ে মারা যাবে, আর কাজের সন্ধানে বাইরে গেলে কোরোনায় মারা যাবে। ফলে, না খেয়ে মরার চেয়ে তারা করোনার আক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে কাজের সন্ধানে বাইরে আসছে। এটি করা ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই, যদি না তারা সরকারের

কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মতো বেশ কয়েকটি সামাজিক সংস্থা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, তরল সাবান এবং খাদ্যসামগ্রীসহ স্যানিটাইজেশনের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করার মতো প্রশংসনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে আসছে। তবে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বস্তিবাসীর চাহিদা মেটাতে এই উদ্যোগগুলো পর্যাপ্ত নয়। খাদ্য এবং স্যানিটাইজেশন সামগ্রী সহায়তা সরবরাহ করার পাশাপাশি, বৃহত্তর পরিসরে সচেতনতা-বর্ধনমূলক কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি। এই জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বার্তাগুলো শুধু লিখিত হলে চলবে না বরং এগুলো ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে প্রদর্শন করতে হবে। বস্তিতে বসবাসকারীদের শিক্ষার হার বিবেচনায় লিখিত যোগাযোগের চ্যানেলগুলোর চেয়ে ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের বার্তা তাদের কাছে সহজে পৌঁছাব।

আমাদের দেশের ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঘরে বসিয়ে রেখে খাদ্য নিরাপত্তাসহ অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য সহায়তা প্রদান করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ জীবিকার সন্ধান না করে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থে বাসায় অবস্থান করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে এই দরিদ্র অভাবী মানুষদের সাহায্য করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হলেও এই মহামারী চলাকালীন বড় বড় শহরে বস্তিবাসীদের জন্য নির্ধারিত কোনো কর্মসূচি নেই। সুতরাং, যদি বস্তিবাসী কভিড-১৯ এ সংক্রমিত হতে শুরু করে, তা এমন এক ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করবে, যা সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে সার্বিকভাবে এই বিশাল সংখ্যার রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি সরকারের নাগালের বাইরে যেতে পারে। কারণ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বস্তিবাসীদের জন্য কভিড-১৯ মোকাবিলায় কোনো সুনির্দিষ্ট

পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে এবং বস্তিগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য সরকারের খুবই দ্রুততম সময়ে বস্তিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এখন একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো কীভাবে বস্তিবাসীদের দুর্দশা হ্র্রাস করা যায় এবং সেখানে সামাজিক দূরত্ব কীভাবে নিশ্চিত করা যায়? সরকারের উচিত বিভিন্ন বস্তিতে বসবাসকারী প্রত্যেক পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য সিটি করপোরেশনগুলোকে ব্যবহার করা। প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর অফিসে উক্ত ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত বিভিন্ন বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের তালিকা থাকার কথা। আবার অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, বস্তিতে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ শহরের ভোটার নয়। ফলে তাদের ভোটার রেজিস্ট্রেশন আইডি দিয়ে খুঁজে বের করা কঠিন। কিন্তু যেহেতু তারা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় বসবাস করে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। তাই ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের মাধ্যমে তাদের বাড়িতে ত্রাণ ও সহায়তা পাঠানো যেতে পারে। যেহেতু অভিযোগ রয়েছে, কিছুসংখ্যক জনপ্রতিনিধি ত্রাণসামগ্রী চুরি করছে এবং তাদের প্রিয় এবং নিকটস্থ ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করে ত্রাণ বিতরণের প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়কে সহায়তা করতে পারে সঠিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করার ক্ষেত্রে। এটি যদি করা যায়, তবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সরকারের উচিত বস্তিতে বসবাসকারী প্রত্যেক পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রেরণের বিষয়টি বিবেচনা করা। আমরা সবাই জানি, একটি পরিবার প্রতিপালনের জন্য শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, আটা, ডাল, আলু এবং তেলই যথেষ্ট নয়। একটি পরিবার বেঁচে থাকার জন্য আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে, যা ক্রয়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন। ফলে, বস্তিবাসীদের শনাক্ত করে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অ্যাস্থার ডুফ্লো ও অভিজিৎ ব্যানার্জি ভারতে কভিড-১৯ মোকাবিলায় লকডাউন সফল করার জন্য প্রত্যেক দরিদ্র পরিবারের হাতে অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেস’ পত্রিকায় তাদের একটি লেখায়। এ ছাড়াও তারা বলেছেন, কভিড-১৯ এর সংক্রমণ যদি শহরের বস্তিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। ফলে, যে কোনো প্রক্রিয়ায় হোক না কেন আমাদের দেশের সরকারের এখন প্রধান কাজ হলো বস্তিগুলোতে যেন কভিড-১৯ এর সংক্রমণ না ছড়ায় সেটি নিশ্চিত করা।

এই সমস্যার আরেকটি মাত্রা হলো বস্তিবাসীদের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কাজ করে। ফলে, এ মুহূর্তে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, যে সব কারখানা বন্ধ রয়েছে সেখানকার পোশাক শ্রমিকরা যেন যথাসময়ে বেতন পায়। গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের কাছে প্রত্যেক কর্মচারীর ফোন নম্বর রয়েছে বিধায় এই মানুষগুলোতে শনাক্ত করা সহজ। বেতন নিশ্চিত করার মাধ্যমে, বড় অংশের মানুষকে ঘরে রাখা যেতে পারে যা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। অনেক বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তি দরিদ্র জনগণকে সহায়তা করছে। ফলে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার যেন সহায়তা বঞ্চিত না হয় এবং একই ব্যক্তি যেন বার বার সহায়তা না পায় সেটি নিশ্চিত করার জন্য এই সার্বিক প্রক্রিয়ায় সমন্বয়

নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

এই সমন্বয়ের কাজটি শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে, আমরা দেখেছি, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও ত্রাণসামগ্রী সুষ্ঠু বিতরণের জন্য পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছিল তাদের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য। পুলিশের এই আহ্বানে কোনো কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সাড়া দিলেও অনেকেই সাড়া না দিয়ে নিজেরা ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন এনজিও দেশের ভিন্নœ ভিন্ন বস্তিতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এসব এনজিও অবশ্যই এই মহামারী চলাকালীন তাদের সুবিধাভোগীদের সহায়তা প্রদান করবে। ফলে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হলে একদিকে যেমন প্রকৃত দরিদ্ররা ত্রাণ সহায়তা পাবে, অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঝুঁকি কমবে। মহামারীকালীন নাগরিকদের রক্ষা করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের একার পক্ষে প্রত্যেককে সহায়তা প্রদান করা খুবই কঠিন। সুতরাং, বস্তিতে বসবাসকারী সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যারা ‘সংকটের মধ্যে একটি সংকটপূর্ণ অবস্থায়’ রয়েছে তাদের রক্ষা করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা যদি প্রত্যেকে আমাদের প্রতিবেশীকে সাহায্য করি, তবে সরকারের বোঝা অনেকাংশে উপশম করবে।

 

লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ,

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর