শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

এ সময় সন্তানের মানসিক যত্ন

এ সময় সন্তানের মানসিক যত্ন

জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই কম বেশি করোনায় সংক্রমিত এবং নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত। এ সময় বড়দের মতো ছোটরাও অনেক শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই চলুন সন্তানের শারীরিক ও মানসিক যতেœর কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক-

রোল মডেল : একজন মানুষের জীবনে অনেক রোল মডেল বা অনুকরণীয় আদর্শ থাকতে পারে তবে তার প্রথম, তাৎপর্যপূর্ণ মডেল হচ্ছে তার বাবা-মা। তাই প্রায়ই বলি বা শুনে থাকি যে, ছেলেটা তার বাবার মতো বুদ্ধিমান হয়েছে, মার মতো গুণবতী হয়েছে, বা রাগী বা ঝগড়াটে হয়েছে...

বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই বাবা, মার আচরণ দেখা অথবা অনুকরণের মাধ্যমে শিখে থাকে। আপনার যদি প্রবণতা থাকে যে কোন সমস্যা মোকাবিলায় রেগে যাওয়া, হতাশ হওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা, কান্নাকাটি করা তাহলে আপনার সন্তানের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দেবে। আর আপনি যদি প্রবলেম সলভিং এপ্রোচ অবলম্বন করেন, যেমন হতে পারে করোনার মতো চ্যালেঞ্জ অথবা আর অন্য চ্যালেঞ্জকে শান্ত ভাবে মেনে নিয়ে, সবদিক বিবেচনা করে, সার্বিক উপায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেন তাহলে অনেকটাই সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে। এতে আপনার সন্তানেরও করোনা মোকাবেলা করার জন্য একই ব্যবস্থা নেওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে। ভালো রোল মডেলের জন্য দরকার চেষ্টা, ভালো চিন্তা ও কাজ করার অভ্যাস এবং নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখা। আপনি সুস্থ থাকলে আপনি সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হয়ে, তাদের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারবেন।                         

রুটিন মেনে চলা :  পরিবারের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট রুটিন রাখুন, তারা কখন ঘুমাবে এবং ঘুম থেকে উঠবে, খাবারের সময়, পড়ার সময়ের রুটিন এতে যার যার কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয় এবং অনেক কাজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আপনি তাদের ছবি আঁকা, বিভিন্ন ছড়া, গল্প বলা ও শেখানো, ব্লক তৈরি করা অথবা ইমাজিনারি খেলার মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত রাখতে পারেন। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের তাদের বয়স ও আগ্রহ অনুসারে তাদের ফ্রি টাইমের জন্য আর্টস, ক্রাফটস, অনলাইনে নাচ, গান শেখা, ডায়েরি, ব্লগ বা গল্প লেখা, বিভিন্ন ভাষা শেখা, জুম বা স্কাইপের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন অনলাইন কোর্স এবং নানা সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, বড়দের ৩০ মিনিট এবং ছোটদের এক ঘণ্টা শারীরিক কার্যাবলিতে যুক্ত থাকতে, তাই তাদের রুটিন করে বিভিন্ন ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করুন।  এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের রিলাক্সেশন মিউজিক শুনে বা মেডিটেশন করে তারা তাদের মন ও শরীরকে ভালো রাখতে পারবে।     

দায়িত্ববোধ বাড়ানো : স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পরিবারের বড়দের এখন অনেক বেশি কাজের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। তাই চেষ্টা করুন আপনার সন্তানের বয়স অনুযায়ী ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দিতে। যেমন, খাবারের পর সে তার নিজের প্লেট পরিষ্কার করা, ফুলের টবে পানি দেওয়া, টিনেজরা ছোট ভাই বোনদের কিছুটা দেখাশোনা করা, রান্নাতে সাহায্য করা, তাদের নিজেদের ঘর, বাড়িঘর গোছানো ও পরিষ্কার রাখা। করোনার সময়ে এই যুদ্ধটা আমাদের সবার তাই সন্তানদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার বোধ তৈরি হওয়া জরুরি। যখন কোন কাজ করবে তাদের প্রশংসা করুন এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়বে।

দুশ্চিন্তার বাক্স ও জার্নালিং :  দুশ্চিন্তা লাঘব করার ক্ষেত্রে লেখা একটি শক্তিশালী মাধ্যম।  বড়দের মতো ছোটরাও রাতে ঘুমানোর সময় আগে কি হয়েছিল বা ভবিষ্যৎ/ আগামীকাল কী হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। যার ফলে মন খারাপ করে থাকে এবং রাতে ঘুমাতে পারে না। তাই করোনার এই অনিশ্চয়তার বা অন্য চ্যালেঞ্জের সময়ে যদি আপনার সন্তানের মধ্যে অনেক মন খারাপ বা ঘুমের অসুবিধা হয় তবে দুশ্চিন্তার বাক্স পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। এটি তিন থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুর জন্য বেশি কার্যকর। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় অথবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পাঁচ-১০ মিনিট ধরে এই প্রক্রিয়া করতে পারেন। আপনি এবং আপনার সন্তান ঠিক করবেন দুশ্চিন্তার বাক্সটি কেমন হবে, হতে পারে এটি টিফিন,টিস্যু বা যেকোন বাক্স। একটি কাগজে আপনার সন্তান তার দুশ্চিন্তা/ মন খারাপের কথা ড্রয়িং করবে বা লিখবে এবং এ বিষয়ে আপনারা দুজন কথা বলবেন, অতঃপর লেখাটি দুশ্চিন্তার বাক্সে রাখবেন। সবশেষে আপনি এবং আপনার সন্তান বাক্সটি কোন নিরাপদ জায়গায় রাখবেন তা ঠিক করবেন। তবে তা বেডরুমে না রাখাই ভালো। লেখা বা ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে সে তার মন থেকে চিন্তা বের করে সেটি দুশ্চিন্তার বাক্সে রাখবে, এতে করে সে তার দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখবে। এই প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক প্রতিদিন চেক করুন।

লেখক : আনার কলি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, এনএইচএস, যুক্তরাজ্য।

সর্বশেষ খবর