শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

করোনা : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা

অধ্যাপক ডা. মো. সোহরাব আলী

করোনা : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা

করোনাভাইরাস নিজেই অদৃশ্য এক মহাশক্তি। কোনো রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে সে আবির্ভূত হয়নি। বিশ্বের বড় বড় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ তার কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। বিশেষ করে যারা তাকে প্রথম অবস্থাতেই অবমূল্যায়ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ ইউরোপিয়ান দেশগুলো কি নিদারুণভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় চলে গেছে। বিশ্বমোড়লদের অনেকেই আবার চীনকে করোনার হেফাজতকারী ও মহামারী বিস্তারকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াসে লিপ্ত। যদিও করোনার প্রতিরোধকারী ভ্যাকসিন ও একে দমনকারী কোনো মহা ওষুধ এখনো একক বা সম্মিলিত কোনো দেশ বা গোষ্ঠী আবিষ্কার করতে পারেনি। বিশ্বের এমন টালমাটাল অবস্থায় করোনা বাংলাদেশের দিকে নজর দেওয়ার আগেই আমরা কিন্তু ডিসেম্বর’ ১৯ থেকে মার্চ, ২০ পর্যন্ত তিন মাস সময় হাতে পেয়েছিল  নিজেদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে প্রথম থেকেই এ সমস্যাটাকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতিতে মোকাবিলা না করে আমলাতান্ত্রিকভাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো করে কতগুলো ফাইলওয়ার্ক করে রাখে। আর আত্মতৃপ্তি নিয়ে ধারণা দিয়েছিলেন যে সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে-করোনা সামনাসামনি আসলেই তাকে ঘায়েল করা হবে। সেই সব অবাস্তব চিন্তা আর সমন্বয়হীনতার নিষ্ঠুর ফল হলো বিগত আড়াই মাসের এই বাস্তবতা।

অতি দক্ষভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালু করা হলো। ফলে চূড়ান্ত সর্বনাশ ডেকে আনা হলো। কিছু কিছু আমলার পরামর্শে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ভাবে (স্বল্প পরিসরে) এ সংকটকে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বিষয়টি আরও আউলা-জাউলা হয়ে গেল। বিশ্ব গণনায় বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের শীর্ষ দিকে অধিকার করলেও তারা হয়তো আত্মতৃপ্তি অনুভব করবেন এই বলে যে, বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এখনো অনেক ভালো আছে। অথচ ১৭ কোটি মানুষের দেশে এখনো আমরা প্রত্যহ ২০ হাজার টেস্ট করতে পারছি না। এমনকি শনাক্তকৃত রোগীদের দ্বিতীয় টেস্ট সবার হচ্ছে কি না তারো কোনো সঠিক রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (গতকাল) বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৫৭ এবং মৃত্যু প্রায় আড়াই হাজার। আর সুস্থ  এক লাখ আট হাজার ৭২৫ জন। যদিও কোনো কর্তাব্যক্তি হয়ত বলতে চাইবেন যে এ ফিগারগুলো স্বল্প পরিসরে সহ্য সীমানার মাঝেই আছে এবং আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। হায় সেলুকাস! পত্রিকা খুললেই দেখা যাবে হাসপাতাল গুলোতে করোনা চিকিৎসার বিছানা নাই্, আইসিইউ নাই, ভেন্টিলেটরের দারুণ অভাব আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নাই। অথচ হাজার হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছে - তাদের অনেকের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাবের বাইরেও অনেক রোগী আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য কভিড চিহ্নিত হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে! এর শেষ কোথায়! জীবন-জীবিকার দ্বন্দ্বে জীবন বিপর্যস্ত আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দেশের ১৭ কোটি মানুষকে। হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করার আগ পর্যন্ত সংগ্রাম করতে করতে যে মরে মরুক-বাঁচতে পারলে বাঁচুক। স্বল্প পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে.... অর্থাৎ মাস্ক ছাড়া শারীরিক দূরত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, বাস, লঞ্চ, স্টিমার এবং কাঁচা-বাজার, মাছের- বাজারে অবাধ স্বাধীন বিচরণ... মানুষকে অনেকটা হলিডে মুডে রেখেছে! তারা আঁচ করতেও পারে না যে খুব সীমিত সময়ের মাঝেই সরকারের স্বাস্থ্য বুলেটিনের শনাক্ত বা মৃতের তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে নিজেরাও। আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনার ভয়াবহতা সত্যিই চিন্তা করার বিষয় কেননা আমাদের সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা করে না। যেহেতু কোথাও কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি সেহেতু আমাদের একমাত্র উপায় হিসাবে লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর নির্ভর করতে হবে তাছাড়া দেশের হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসার জন্য অনেক চেষ্টার পরও যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। অর্থনৈতিক লাভালাভের জায়গা থেকে মানুষের জীবনকে ‘খরচযোগ্য’ বিনিয়োগ ভাবা শুধু নিষ্ঠুরতাই নয়-হৃদয় বিদারক! যে অর্থনীতি চালু রেখে মানুষের জীবন বাজি রাখতে হয় সেটা ঠিক নয়। সবার আগে সেই অর্থনীতির উচিত ছিল মানুষকে বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা। শিথিল লকডাউনে মানুষ যে বেরিয়ে পড়ছে এর দায় মানুষের নয়। মানুষ কোনো ভরসা পাচ্ছে না অনবরত সিদ্ধান্ত বদল, চিকিৎসার ভজকট এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কোনো পরিকল্পনা না দেখতে পেলে তো নিয়তির হাতে নিজেদের দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আমি মনে করি ‘হার্ড ইমিউনিটি’ লক-ডাউন ভাঙার অজুহাত হতে পারে না। এই ‘দলবদ্ধ প্রতিরোধক্ষমতা’ জন্মানোর জন্য করোনার কাছে দেহটা এগিয়ে দেয়া- গণমৃত্যুর আয়োজন ছাড়া কিছুই বলা যায় না। দেরিতে হলেও  বিএমএ-স্বাচিপ নেতৃবৃন্দও মুখ খুলে বলেছেন যে অব্যবস্থা ও সমন্বয়হীনতা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পর্য্যুদস্ত করে দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে লাল-হলুদ-সবুজ এলাকা পৃথকীকরণ। যা করা উচিত ছিল মার্চের শেষে অথবা এপ্রিলের শুরুতেই- আরও ৭০/৭৫ দিন আগেই। জানি না জোন ভাগ করতে গিয়ে আবার নতুন কোনো ভুল করে করোনার হাতে সবুজ জোনগুলো ছেড়ে দিচ্ছি কিনা! মডেলিং গ্রাফ করে আমাদের অনেক আগেই দেখা উচিত ছিল পিক লেভেল কখন কত হতে পারত আর কতদিনই বা সেটা কিভাবে স্থায়ী হতো। তা আমরা করিনি। দেরিতে হলেও জোন ভাগ করা হচ্ছে। যেহেতু বিভিন্ন প্রতিকূলতার জন্য প্রথম দিকে কভিড-১৯ এর জন্য আর টি-পি সি আর টেস্ট আশানুরূপভাবে আমরা করতে পারিনি তবে এখন টেস্টের সংখ্যা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে থেমে থাকলেই চলবে না। টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শ নিয়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে আরও সুসজ্জিত ল্যাব স্থাপন করতে হবে এবং দক্ষ লোকের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ এবং টেস্টের সংখ্যা প্রতিদিন ৩০ হাজারে উন্নীত করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে শনাক্তকরণ জোরদার করে দেশব্যাপী সঠিক ‘জোনিং’ সম্পন্ন করে পরবর্তী সঠিক পদক্ষেপ অতি জরুরিভিত্তিতে  নিতে হবে। শনাক্তকৃত রোগীদের রেকর্ড সঠিকভাবে মনিটরিং করে তাদের ২য়/৩য় টেস্ট নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও

অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মেডিকেল বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

সর্বশেষ খবর