সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড আক্রান্ত ও রোগ-পরবর্তী সম্ভাব্য কিছু জটিলতা

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

কভিড আক্রান্ত ও রোগ-পরবর্তী সম্ভাব্য কিছু জটিলতা

মিসেস নির্মলা পেশায় একজন সেবিকা, দেশের একটি বৃহৎ কভিড হাসপাতালে কভিড রোগীদের ক্লান্তিহীন সেবাদান করে নিজেই আক্রান্ত হন কভিড-১৯ এ। রোগটিতে মাঝারি তীব্রতায় ভোগার পর তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু এখন তিনি মুখোমুখি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার- সীমাহীন ক্লান্তি। এদিকে নির্ধারিত নির্দিষ্ট ছুটির পর খুব শিগগিরই তার ডাক পড়েছে হাসপাতালে কভিড রোগীদের সেবাদানে আবার নিয়োজিত হওয়ার জন্য। কিন্তু উনি আজ দ্বিধান্বিত, এ সীমাহীন দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি ও অবসন্নতা নিয়ে উনি কি পারবেন আবারও কর্মক্ষেত্রে একই উদ্যমে সেবা দিয়ে যেতে?

মকবুল সাহেব প্রবাসফেরত একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা কভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সেবা গ্রহণ করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশের বাড়ি সিলেট ফিরে গেছেন। তবে বাড়ি ফেরার পর এখন তার সমস্যা হচ্ছে রাতে ঘুম একদম হয় না বললেই চলে, মনে হয় যেন ঘুমাতেই ভুলে গেছেন।

জাকারিয়া, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তীব্রভাবে কভিডে আক্রান্ত হয়ে হাইফ্রো ন্যাসাল ক্যানুলার সাহায্যে ৬০ লিটার অক্সিজেন গ্রহণ করে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছেন। এখন তার প্রধান সমস্যা খুসখুসে কাশি, সামান্য পরিশ্রমে এমনকি ওয়াশরুমে যেতেও হাঁপিয়ে উঠেন। উপরে বর্ণিত রোগীদের বর্ণনাগুলো একদম সত্যি ঘটনা, নামগুলো শুধু ছদ্মনাম। কভিড পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ রোগীর এমন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাই চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের নতুন চ্যালেঞ্জ ‘কভিড-১৯ পরবর্তী চিকিৎসা’-এক নতুন অধ্যায়। রোগ-পরবর্তী সময়ে এদের অনেকেরই একান্ত উদ্বেগের বিষয় ‘এরপর কী? সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব কি? এখন আমাদের কী করণীয়?’ বস্তুত কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ রোগটির কিছু ধারাবাহিক জটিলতা আবির্ভূত হতে পারে। তাই প্রতিটি করোনা রোগীর এ ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি। এ জন্য কিছু সম্ভাব্য জটিলতা নিয়ে এ আলোচনা।

কভিড আক্রান্ত রোগীদের রোগ-পরবর্তী সম্ভাব্য জটিলতা

বক্ষব্যাধিবিষয়ক সমস্যা : আমরা জানি করোনা রোগটি প্রাথমিকভাবে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। যদি ভাইরাসটি ফুসফুসের সীমিত ক্ষত (গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটি, সীমিত কনসলিডেশন ইত্যাদি) সৃষ্টি করে, তাহলে আমাদের দেহ স্বাভাবিক শরীর বৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সেই ক্ষত পূরণ করে নেয় ও ফুসফুস স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলে। কিন্তু আক্রান্ত ক্ষত যদি ব্যাপক হয় (যেমন- উভয়দিকের মারাত্মক কনসলিডেশন, এআরডিএস, ভাসকুলার থিকেনিং ব্রংকিয়েকটেসিস ইত্যাদি) তাহলে কখনো কখনো এ ক্ষতগুলো পূরণ হওয়ার পরও ফুসফুসে স্কার বা ফাইব্রোসিস, বা সহজ বাংলায় ‘দাগ’ থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রম অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হতে পারে। রোগী অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। স্বাভাবিক সাংসারিক ও দাফতরিক কাজকর্ম করা কষ্টসাধ্য হয়ে যেতে পারে। পরবর্তীতে ঘন ঘন কফ, কাশি, বুকে ব্যথা, ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষত যারা আগে থেকেই বিভিন্ন শ্বাসজনিত রোগ যেমন অ্যাজমা, সিওপিডি ও অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছিলেন তাদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা অধিক হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে নিয়মিত বক্ষব্যাধি চিকিৎসকের পরামর্শ, ধারাবাহিক ফলোআপ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করলে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। ব্রিটিশ থোরাসিক সোসাইটির পরামর্শ অনুযায়ী করোনা-পরবর্তী তিন মাস পর অবশ্যই প্রত্যেক রোগীর একটি বুকের এক্স-রে এবং পালমোনারি ফাংশন টেস্ট করে নেওয়া উচিত। এছাড়া পালমোনারি পুনর্বাসন একটি প্রতিষ্ঠিত কিন্তু অপ্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। করোনা-পরবর্তী সময়ে এর ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

হৃদরোগবিষয়ক সমস্যা : করোনাভাইরাস আমাদের হৃদযন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে। যেমন ভাইরাল মায়োর্কাডাইটিস, ডায়ালেটেড কারডিওমাওপ্যাথি ইত্যাদি। এসব রোগীর বুক ধড়ফড় করা, অস্থিরতা, বুকে ব্যথা এমনকি শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পানি আসা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো মৃদু লক্ষণ এবং এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এ লক্ষণের সঠিক চিকিৎসা সময়মতো না হলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে।

নার্ভ ও ব্রেইনের বিভিন্ন সমস্যা : অনেক সময় কভিড রোগী শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার পাশাপাশি কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ নিয়েও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। যেমন ব্রেইন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধা। এ ছাড়া ভাইরাসের প্রভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভিন্ন খাতে অতিরঞ্জিতভাবে ব্যবহৃত হয়ে যেভাবে ফুসফুসের ক্ষতিসাধিত হয় একইভাবে এটি বিভিন্ন নার্ভের ক্ষতি করে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে দুর্বল করে দিতে পারে। সার্স, মার্স ও অন্যান্য সাধারণ কয়েকটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমন রোগের (যেমন গুলেন বাড়ি সিনড্রোম, ট্রাসভার্স মায়ালাইটিস, সিআইডিপি এনকেফালাইটিস ইত্যাদি) প্রাদুর্ভাবের রিপোর্ট করা রয়েছে। এসব রোগের ফলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের অসারতা, ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা, স্পর্শ বা অনুভূতি বোধের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। তবে এগুলো খুব কম ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য ভাইরাসের মতো সার্স কোভ-২ বা করোনাভাইরাস একইভাবে এসব জটিল নিউরোলজিক্যাল রোগ করতে পারে কিনা সেটি বলার সময় এখনো আসেনি। এ জন্য প্রয়োজন আরও কিছুটা সময় এবং এ সময়ে দীর্ঘস্থায়ী নিবিড় পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও উপাত্ত বিশ্লেষণ।

রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তনালির বিভিন্ন সমস্যা : কভিড- ১৯ আক্রান্তকালীন যখন রোগটি সবচেয়ে তীব্রতর অবস্থা থাকে তখন শরীরের বিভিন্ন রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা দেয়। এ রক্তনালি দ্বারা সরবরাহকৃত অঙ্গ অনুযায়ী সেসব অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে যেমন ফুসফুস, হার্ট, ব্রেন, কিডনি, হাতের বা পায়ের গভীর রক্তনালি ইত্যাদি। তাই চিকিৎসকরা প্রথম থেকেই রক্ত তরল করার বিভিন্ন ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে মুখে খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু এই রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া কতদিন স্থায়ী হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।

অন্যান্য প্রত্যঙ্গে প্রভাব : কভিড রোগাক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সার্স কোভ-২ দ্বারা আকস্মিক কিডনি বিকল, আকস্মিক লিভার বিকল ইত্যাদি রোগের মোকাবিলা করে থাকেন। কিন্তু কভিড রোগটি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর বিকল হওয়া এ কিডনি বা লিভার সম্পূর্ণ আগের অবস্থায় ফিরবে, নাকি কিছু ক্ষতি রয়ে যাবে- সেটা নির্ণয়ের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। বিশেষত যারা আগে থেকেই কিডনি, লিভারের বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন, তাদের জন্য ব্যাপারটি আরও গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণ কিন্তু সবচেয়ে অসুবিধাজনক কিছু সমস্যা : এ পর্যন্ত আলোচিত এসব মারাত্মক ও ভীতিকর রোগের বর্ণনায় আতঙ্কিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে উপরে উল্লেখিত সমস্যাগুলো অত্যন্ত সামান্যসংখ্যক ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে সাধারণ কভিড রোগীদের এক তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগ-পরবর্তী সময়ে রোগীরা প্রচন্ড দুর্বলতায় ভোগেন। এছাড়া কাজে অমনোযোগিতা, মানসিক বিক্ষিপ্ততা, মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা, হাত-পা জ্বালাপোড়া ইত্যাদি সমস্যায়ও ভোগেন। অনেকের ক্ষেত্রে নিকট অতীতের স্মৃতিভ্রম হয়, নতুন কিছু শেখা বা করার ক্ষেত্রে ধীরগতি, দ্বিধা, একাকিত্ব বোধ, মতিভ্রম ইত্যাদি হতে পারে। অনেকে আবার আইসিইউ বা কভিড হাসপাতালের ভীতিকর স্মৃতিতাড়িত হয়ে উদ্বেগে ভুগেন। এছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে ‘কাওয়াসাকি রোগের’ মতো একটি রোগের লক্ষণ, পুরুষদের ক্ষেত্রে সাময়িক বন্ধ্যত্ব, মহিলাদের গর্ভধারণজনিত জটিলতা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন। তাই এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও

কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর