রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

হৃদরোগ ও করোনাভাইরাস

ডা. মাহবুবর রহমান

হৃদরোগ ও করোনাভাইরাস
যাদের হৃদরোগ আছে তবে হার্টের পাম্পিং ফাংশন ভালো তাদের সমস্যা কম। তারা যেসব ওষুধ নিয়মিত খেতেন তা চালু রাখতে হবে। সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি কিন্তু শ্বাসকষ্ট নেই তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবেন

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সম্প্রতি পালিত হলো বিশ্ব হার্ট দিবস। এদিকে করোনা পরিস্থিতি বিশ্বকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে, দিন-রাত সর্বক্ষণ এটি আমাদের তাড়া করে ফিরছে। অর্থাৎ আমাদের আসল যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে এক সুদূরপ্রসারী মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। যে কোনো বৈশ্বিক মহামরীতে এরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে দিন শেষে আমরা যতই আতঙ্কিত হই না কেন, একটা নতুন আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি যেন আগামীকালটা আরেকটু ভালো হয়। বর্তমানে হৃদরোগ এখন  বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি। অন্যান্য রোগের তুলনায় হঠাৎ মৃত্যুর আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি হৃদরোগে।  বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো মুহূর্তে সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে পারে। একটি মানুষের মৃত্যু শুধু নয়, গোটা পরিবারের ওপর নেমে আসে বিপর্যয়ের গভীর অমানিশা। বিশেষ করে মানুষটি যদি হয় পরিবারের আয়ের প্রধান ব্যক্তি। তাই আমাদের হাতে সময় থাকতে সচেতন হওয়া দরকার কীভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিটি রোগের চিকিৎসার দুটো ধাপ থাকে। একটি হলো রোগ প্রতিরোধ, যাতে রোগটি শরীরে বাসা বাঁধতে না পারে। আর দ্বিতীয়টি হলো প্রতিকার, রোগটি দিয়ে আক্রান্ত হলে তা থেকে মুক্তির চেষ্টা। বলা বাহুল্য, প্রতিকার নয় রোগ প্রতিরোধই উত্তম। ধরা যাক রাজধানী থেকে দূরে কারও হার্ট অ্যাটাক হলো। প্রাথমিক চিকিৎসা এখন মোটামুটি সব জায়গাতেই আছে। সেটা না হয় দেওয়া গেল। কিন্তু উন্নত আধুনিক চিকিৎসা তো রাজধানীসহ সামান্য কিছু কেন্দ্রে বিদ্যমান। তাই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিটি রাজধানীতে পৌঁছতে পৌঁছতে স্বাভাবিকভাবেই বিলম্ব করবে। তাতে কী সমস্যা হবে? হার্ট অ্যাটাকে যত মৃত্যু হয় তার শতকরা ২৫ ভাগই ঘটে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে। সুতরাং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি চারজনের একজন কখনো হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাবেন না। বাকি তিনজন যখন কোনো আধুনিক হাসপাতালে পৌঁছবেন তখন যদি ১২ ঘণ্টার বেশি দেরি হয়ে যায় তাহলে হৃৎপিন্ডের মাংসপেশির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্কের কোষ বা টিস্যু যদি একবার ধ্বংস হয় তাহলে তা হয় অফেরতযোগ্য এবং অপরিবর্তনযোগ্য। অর্থাৎ সময়ই এখানে মুখ্য নিয়ামক। টাইম ইজ লাইফ! যদি রোগী প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বেঁচে যান তাহলেও তার জন্য অপেক্ষা করছে সারা জীবনের মতো অসহায় দুর্বল এবং অন্যের ওপর নির্ভরশীল সংক্ষিপ্ত এক জীবন। এবার আসি মানসিক অভিঘাত বিষয়ে। হার্ট অ্যাটাক এমনই এক অকস্মাৎ আঘাত যে, এর জন্য কেউই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। তাই যখন সেটি আসে তখন রোগী দিশাহারা হয়ে পড়ে। মৃত্যুভয় তাকে আঁকড়ে ধরে। রোগী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের রোগীর হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। হার্ট ফেইল্যুর এবং হঠাৎ মৃত্যুরঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদি হতাশা এবং অবসাদ রোগীকে ঘিরে ধরে। জীবন ও কাজের প্রতি অনীহা ও বিরাগ রোগীকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, রোগীর আয় ইনকাম কমে পরিবারটিকে একটি অনিশ্চিতের দিকে ধাবিত করে।

এখন আসি যাদের হৃদরোগ আছে তাদের করোনা ইনফেকশন হলে কী করার আছে।

হৃদরোগীরা দু’ভাবে আক্রান্ত হতে পারেন :

১। যারা আগে থেকে হৃদরোগে ভুগছিলেন।

২। এছাড়া যারা করোনা ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নতুন করে

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

যারা আগে থেকে হৃদরোগে ভুগছেন :

যাদের হৃদরোগ আছে তবে হার্টের পাম্পিং ফাংশন ভালো তাদের সমস্যা কম। তারা যেসব ওষুধ নিয়মিত খেতেন তা চালু রাখতে হবে। সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি কিন্তু শ্বাসকষ্ট নেই তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। সম্ভব হলে প্রেসার, নাড়ির গতি, তাপমাত্রা পরীক্ষা করবেন। খাদ্য স্বাভাবিক খাবেন, পানি পর্যাপ্ত খাবেন, সতেজ ফলমূল, শাকসবজি প্রচুর খাবেন। যাদের কোনো উপসর্গ নেই লকডাউন অবস্থায় ঘরের ভিতরে তিরিশ মিনিট খালি পেটে হাঁটবেন। সম্ভব হলে বাড়ির ছাদে রোদের মধ্যে হাঁটবেন। তবে সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন।

যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় যেমন-জ্বর বেড়েই চলছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, প্রেসার ওঠানামা করছে তাহলে ডাক্তারকে ফোন করুন। তার নির্দেশ মতো নির্দিষ্ট হাসপাতালে যান। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা যেমন- CBC, Xray chest ইত্যাদি করে সিদ্ধান্তে আসবেন যে, আপনার হাসপাতালে ভর্তি লাগবে কিনা।

ভর্তির পর করণীয় : ভর্তির পরে চিকিৎসা পদ্ধতি পরিস্থিতি অনুযায়ী আপডেট করতে হবে।  রোগীর কাজ হলো স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতা করা, তাদের নির্দেশনা মেনে চলা। যদি রোগীর প্রেসার, পালস, অক্সিজেন মাত্রা স্বাভাবিক থাকে তাহলে হাইকেয়ার করোনা ওয়ার্ডে রেখেই চিকিৎসা করা যাবে। সেটি হতে হবে করোনা নিবেদিত ওয়ার্ড যেখানে পূর্ণ পিপিই নিরাপত্তা থাকবে।

অন্যদিকে যেসব রোগী হার্ট অ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবেন তাদের চিকিৎসাও বিশেষ পদ্ধতিতে করতে হবে। তাই করোনার এই সময়ে আমাদের সবাইকে যথেষ্ট সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে হৃদরোগীদের আরও বেশি যত্নবান হতে হবে। বাসায় যদি কোনো হৃদরোগী থাকেন তাহলে পরিবারের সবাইকে আরও সজাগ হতে হবে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে যা যা  প্রয়োজন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। ছোট খাটো বিষয়ে এ সময় হৃদরোগীদের সরাসরি হাসপাতালে না যাওয়াই উত্তম।

লেখক : কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ,

ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর