শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

সুস্থতায় বাধা টেকনো আসক্তি

ডা. অপূর্ব চৌধুরী

সুস্থতায় বাধা টেকনো আসক্তি

মানুষ এখন হাতঘড়ির দিকে গড়ে তিনবার তাকায় দিনে, কিন্তু ফোনের দিকে গড়ে ৫২ বার তাকায়।  এই হিসাবে বছরে বিশ হাজার বার ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিন চেক করে

 

এখন টেকনোলজির যুগ। জীবনের সর্বত্র টেকনোলজির স্পর্শ। নিত্য কাজে হাজার টেকনোলজির মধ্যে অন্যতম হলো- ফোন, কম্পিউটার, টিভি এসব। ১৫৭০ সালে কুইন্স অফ নেপলসের জন্য প্রথম হাতঘড়ি বানানো হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ‘মানুষের জন্য বাজারে আসতে তা ২০০ বছর লেগেছিল। ১৮১২ সালে সাধারণ মানুষ প্রথম হাতঘড়ি পরা শুরু করে। এখন আরও ২০০ বছর পর স্মার্ট ওয়াচ পরে। তবে এখন সেই স্মার্ট ওয়াচে সময় দেখার চেয়ে অন্য কিছু দেখে। মানুষ এখন হাতঘড়ির দিকে গড়ে তিনবার তাকায় দিনে, কিন্তু ফোনের দিকে গড়ে ৫২ বার তাকায়। এই হিসাবে বছরে বিশ হাজার বার ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিন চেক করে। দৈনন্দিন জীবনে আর কোনো বস্তু এমন করে মানুষকে এতটা আগ্রহী করে তোলেনি। সারা দিনে খাওয়া-দাওয়া করতে এখন যত সময় যায়, তার চেয়ে লোকে এখন বেশি সময় দেয় মোবাইল ফোনে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক আমরা আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় ফোনের পেছনে ব্যয় করি। তিন-বেলা খেতে নিশ্চয়ই এত সময় ব্যয় করি না আমরা। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে একজন মানুষ সারা দিনে খাবার খেতে এক ঘণ্টার চেয়ে কিছু বেশি সময় ব্যয় করে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন-তিন বেলা খেতে আপনার কতটা সময় লাগে। একসময় চিকিৎসকরা ড্রাগ এডিকশন বা মাদকাসক্তির চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। একুশ শতকে এসে মাদকাসক্তির চেয়ে টেকনো আসক্তি বা প্রযুক্তির আসক্তি চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলেছে। প্রযুক্তি আসক্তির মধ্যে প্রধানত মোবাইল ফোন প্রধান। তার পরে আছে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেম, মোবাইল গেম, গেম কনসোলের গেম। পূর্বের দেশগুলোতে প্রভাবটি কম থাকলেও গ্যাম্বলিং অথবা অনলাইন গ্যাম্বলিং বা অনলাইন ক্যাসিনো, জুয়া- এসবও এখন পশ্চিমে টেকনো  আসক্তির মধ্যে পড়ে। কেউ কেউ গোটা ব্যাপারটিকে ডিজিটাল আসক্তি বা ইন্টারনেট এডিকশান বলতে চায়। তবে এ নিয়ে মতানৈক্য আছে। সমস্যাটি কি ডিভাইসের বা যন্ত্রের, নাকি প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর, নাকি শরীরের ওপর প্রযুক্তির প্রভাব।

যন্ত্র একধারে জীবনকে সহজ এবং উন্নত যেমন করেছে, একই সঙ্গে অন্য ধারে যন্ত্র আমাদের এডিক্ট বা আসক্ত করেছে।

শরীরে, বিশেষ করে, মস্তিষ্কে ড্রাগ বা মাদক ঠিক যেমন করে আসক্তি গড়ে তুলে, বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা দেখলেন-ঠিক একইভাবে প্রযুক্তি বা যন্ত্রের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কে সমান প্রতিক্রিয়া এবং একই ধরনের আসক্তি তৈরি করছে। সঙ্গে দেখা দিচ্ছে শারীরিক এবং বিভিন্ন মানসিক সমস্যা। ফলে যন্ত্রের সুফল পেতে গিয়ে যন্ত্রের দানব রূপটিও আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসছে। কিন্তু এর সমাধান কোথায়। এ নিয়ে ভাবনার আগে আরেকটি বিষয় জেনে নিই-এই যন্ত্র আসক্তির ধরন কেমন, কী সমস্যা তৈরি করছে, কেমন করে করছে।

সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সমাধানের অর্ধেক।

অভ্যাস এক জিনিস, বদ অভ্যাস আরেক জিনিস। স্বভাব এক ব্যাপার, আসক্তি আরেক ব্যাপার। স্বভাব হলো একটি কাজ বারবার করার কারণে যে অভ্যাস তৈরি হয়। এডিকশন বা আসক্তি হলো সেই কাজ প্রয়োজনের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত করা।

কিন্তু কী করে বুঝবেন-কোনটি স্বভাব, কোনটি আসক্তি! স্বভাবের অভ্যাস দৈনন্দিন কাজের অংশ হিসেবে গড়ে ওঠে, ফ্লেকিসেবেল, চাইলে সময়ে পরিবর্তন করে নিতে পারেন। কিন্তু আসক্তি তার বিপরীত। আসক্তির কাজ কোনো প্রয়োজন ছাড়াই বারবার করতে থাকেন, যা করতে থাকেন, তা নিজের অন্য কাজের ক্ষতি করলেও একই কাজে লেগে থাকেন এবং সময়ে নিজেকে সেই বদ অভ্যাসটি থেকে সহজে বের করে আনতে পারেন না। বুঝতে হবে ব্যাপারটি আর আপনার স্বভাব নেই, আপনি ওটায় আসক্ত।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ষাট ভাগ কোনো না কোনোভাবে মোবাইল ফোনে আসক্ত কোনো একটা সময়ে। এই আসক্তদের অর্ধেকের চেয়ে বেশি হলো টিন-এজ এবং তরুণ তরুণীরা।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের টেকনো যন্ত্রপাতিতে এখন বিশ্বের আট থেকে দশ পার্সেন্ট প্রাপ্তবয়স্ক আসক্ত।

আসক্তির ফল জীবনকে একদিকে যেমন বিষাক্ত করে ফেলে, সঙ্গে সমাজ, পরিবেশ এবং অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে। যন্ত্র, বিশেষত মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের লোকেরা সবচেয়ে বেশি ভুগছে নির্ঘুমতায়। লোকের চোখ এখন অন্ধকারেও ফোনের স্ক্রিনে বিড়ালের মতো তাকিয়ে পিট পিট করে।

একুশ শতকে মানুষের ঘুমের কোয়ালিটি কমে গেছে। ঘুমের সময় নিজেরাই কমিয়ে ফেলেছে। আবার যেটুকু বিছানায় পিঠ দেয়, তখনও ফোনের স্ক্রিনে প্রহরীর মতো চোখ রাখে। বিশ্রাম বাড়লেও ঘুম বাড়েনি। ঘুম বাড়লেও ঘুমের গভীরতা বাড়েনি। ফলে দেখা দিচ্ছে শরীরে প্রতিক্রিয়া। চোখের সমস্যা থেকে মস্তিষ্কে সমস্যা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে খাদ্যাভ্যাসে সমস্যা। মোটা হয়ে যাওয়া থেকে, সহজে এবং স্থূল বিষয়ে বিষণœতায় ভোগা, বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় জড়িয়ে যাওয়া থেকে আত্মহত্যা, ক্রনিক হতাশা থেকে অস্থিরতা।

মুখের সামনে যন্ত্র নিয়ে বসে থাকতে থাকতে মানুষ এখন অনেক অসামাজিক, শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে অলস সময় কাটানো প্রাণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী রোগ মুক্ত শরীর মানে সুস্থতা নয়। শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক, তিনটি দিকেই ভালো থাকাকে সুস্থতা বলে। সময় এসেছে উঠে দাঁড়ানোর। যন্ত্র এবং মানুষের যুদ্ধে জয় হওয়ার। মানুষ যন্ত্রের আবিষ্কার এবং তৈরি করেছে এবং করছে তার জীবনকে সহজ করতে, স্বাস্থ্যকর করতে এবং নিজেকে ভালো রাখতে। কিন্তু তার বিপরীতে ছুটলে বলতে হবে নিজেদের তৈরি যন্ত্র এখন নিজেদেরকেই দখল করে বসেছে। টেকনো আসক্তির আরেক নাম একুশ শতকের যন্ত্র মহামারী। তাই এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

লেখক : ইংল্যান্ড প্রবাসী চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর