শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

এখন আর ভয় ডর নাই!

ডা. মোজাহার হোসেন

এখন আর ভয় ডর নাই!

হাসপাতালে কান পাতলেই কারও না কারও করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ক্লান্ত বিষণ্ন সবাই। তারপরও পেশাদারিত্বে কারও কোনো অবহেলা নেই। রোগী এলে সব ভুলে অবলীলাক্রমে রিসিভ করা হচ্ছে রোগীকে

ভালো থাকবেন স্যার, ভালো থাকিস ভাই, দোস্ত সাবধানে থাকিস, চলাফেরা করো সাবধানে। কাহাতক আর এ সব কথা শোনা যায় প্রতিদিন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, অধস্তন কর্মচারী সবার কথায় একই সুর। ফোন এলে একই কথার পুনরাবৃত্তি। কানের মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। সাবধানের কী আছে! আমার কর্মস্থল তো হাসপাতালেই, তাও আবার জরুরি বিভাগের পাশে। রোজ সকালে গিয়ে বিকালে আসা। সপ্তাহে একদিন বিরতি। গত বছরের মার্চ থেকে পুরোটা সময় পার করেছি নাক মুখ চোখ ঢেকে। এবারও তাই। বসার ঘরের দরজা খুললেই নানান চেহারার রোগী। কেউ কাশছেন, কেউ জ্বরে কাহিল, কেউ দিচ্ছেন হাচ্ছি, কারও আবার গলাব্যথা, মাথাব্যথা। আমার বসার ঘরের দেয়ালের ওপর থেকে ফোন করে রোগীর উপসর্গ ভেদে ইএমও সাহেবরা জানতে চান, কাকে কোথায় পাঠানো যাবে। ভারাক্রান্ত মনে বলতে হয় এখানে কভিড রোগীর চিকিৎসার ঘাটতি রয়েছে, অন্য কোথাও পাঠাও। কোথায় পাঠাব স্যার- যেখানেই খোঁজ করি সেখান থেকেই উত্তর আসে বিছানা খালি নেই। আইসিউতে তো নয়ই। কয়দিন আগে মাঝ রাতে ফোন পেলাম এক ব্যাংক কর্মকর্তার। তাঁর স্বামীর করোনা পজিটিভ। একটা আইসিইউ বেড লাগবে। আমাদের এখানে করোনা ইউনিট নেই সেটা তিনি জানেন। অনেক স্থানে ফোন করে শেষ অবদি গ্রিন রোডের এক হাসপাতালে ঠাঁই হলো তাঁর স্বামীর। পরে জেনেছি তাঁর স্বামী সুস্থ হয়েছেন। বড়ই পরোপকারী মানুষ এই আপা। ষাটোর্ধ্ব তাঁর বাবা কানাডা থেকে এসে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই আপা নিজে সেবা করে তাঁকে সুস্থ করেছেন। বাবা ও স্বামীর সেবা করার পর তিনিও ভালো আছেন। অব্যাহত রেখেছেন ব্যাংকের সেবা কাজ। ১১ এপ্রিল ব্যাংকে কিছু সময় বসে ছিলাম ম্যানেজারের কক্ষে। লোকজন লাইন দিয়ে টাকা তুলছে। ৪/৫/৭ লাখ অঙ্কের টাকাও তুলছেন অনেকে। এক ভদ্রলোক ৮ লাখ টাকার চেক এনে ম্যানেজারকে বললেন, একটু দ্রুত টাকাটা পাওয়ার জন্য। গত কদিন আগে সৌদি থেকে আসা ভদ্রলোক জানালেন এই টাকা একটি বড় হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসাধীন তাঁর বড় ভাইয়ের জন্য খরচ হবে। পরবর্তীতে ম্যানেজার সাহেব জানালেন, আজ বড় অঙ্কের যে টাকা উত্তোলন হচ্ছে তাঁর বেশির ভাগই যাচ্ছে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য। হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব-এগুলোই তো করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার মূল মন্ত্র। কর্মকালীন সময়ে চিকিৎসক ও অন্যান্য স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা কীভাবে এ নিয়ম না মেনে চলবে? তাঁদের তো রোগীর কাছে যেতেই হয়। যান যান দূরে থাকেন, এভাবে কথা বললে রোগীরা মনে ব্যথা পাবেন। এ করোনাকালে মনে ব্যথা দেওয়া তো রোগীর অসুস্থতা আরও একধাপ বাড়িয়ে দেওয়া। চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রি নিয়ে এ পেশার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে করোনা মুক্ত থাকা সৃষ্টিকর্তার অপার অনুগ্রহ ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের সবারই এখন প্রার্থনা, করোনা যেন আমাদের করুণা করে। আমার কর্মস্থলে জরুরি বিভাগ, মেডিসিন, শিশু, সার্জারি, নবজাতক, আইসিইউ এসব বিভাগে গত বছর আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ বছর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ৯ জন চিকিৎসক। মৃত্যু নেই। তবে আছে চরম শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদ, স্মৃতিভ্রম এসব কিছু। তিনজন কাজে যোগ দিয়েছেন। ছয়জন নিজ বাসায় চিকিৎসাধীন। করোনার আতঙ্ক এ বছর আরও বেশি। যতই আমরা বলি আতঙ্কিত হবেন না, ততই বেড়ে যাচ্ছে আতঙ্ক। প্রতিদিনের আক্রান্ত ও মৃত্যুর আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতি এ আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালের করিডোরে কান পাতলেই কারও না কারও করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ক্লান্ত বিষণ্ন সবাই। তারপরও পেশাদারিত্বে কারও কোনো অবহেলা নেই। রোগী এলে সব ভুলে অবলীলাক্রমে রিসিভ করা হচ্ছে রোগীকে। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা। এসব করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। সুস্থ হয়ে আবারও কর্মস্থলে কাজ করছে। চিকিৎসা ও সেবাযত্নে জড়িতদের মুখে একটাই কথা এখন আর ভয়-ডর নাই।  আমরা পেশাদারিত্বের দ্বায়বদ্ধতার কারণে করোনা আক্রান্তদের পাশে সবসময়ই দাঁড়িয়েছি,  এখনো দাঁড়াব।

লেখক : উপ-পরিচালক, সেন্ট্রাল হাসপাতাল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর