শনিবার, ১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

রোজার মহিমা ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

রোজার মহিমা ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা

রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান। এ মাস ফজিলতের মাস, গুনাহ মাফের মাস, নেক আমল দিয়ে নিজেকে সাজানোর মাস। রোজা ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। রোজা ছাড়া কোনো ব্যক্তির ইসলাম পূর্ণ হয় না। রোজা রাখার মাধ্যমে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ করে। মহান আল্লাহ বলেন, “হে মুমিন! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’ (সুরা বাকারা-১৮৩)। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কোনো বিধানই লক্ষ্যহীন নয়। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি ও বিধানের পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। মাহে রমজানের রোজা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও বিধান। এটিকে আল্লাহ ইমানদারদের জন্য ফরজ করেছেন। এই বিধানের অন্যতম লক্ষ্য হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতির গুণ অর্জন করা। যথাযথ রোজা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা রোজাদার ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আমাদের মহান রব ইরশাদ করেছেন, রোজা ঢালস্বরূপ। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য, আর আমিই এর পুরস্কার দেব’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-১৪৬৬৯)। রসুল (সা.) আরও বলেন, ‘রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-৫৯২৭)। রসুল (সা.) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রোজা রাখবে, তার আগের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে (বুখারি-৩৮)।

কোন কোন অবস্থায় রোজা না রাখা বৈধ বা কোন কোন শারীরিক জটিলতায় রোজা ভাঙা যায় : রমজান মাসে রোজা রাখা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় বিধান। ইসলাম অনুমোদিত অপারগতা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মুসলমানের এই বিধান পরিত্যাগ করার অনুমতি নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ রোজা ভঙ্গ করলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে বড় পাপী এবং পরকালের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি। আর যারা যথাযথ রোজা পালন করবেন, তাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য পুরস্কারের বিধান। ইসলামে মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও সাধ্যের বাইরে কোনো বিধান দেওয়া হয়নি। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ কারও ওপর এমন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত’ (সুরা-বাকারা-২৮৬)। রমজান মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ, ‘যে ব্যক্তি রোজার মাসটি পাবে, তারই কর্তব্য হচ্ছে রোজা রাখা’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ ব্যাধিগ্রস্ত হলে বা সফরে থাকলে, অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এটা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয়, তাদের কর্তব্য, এর পরিবর্তে ফিদিয়া অর্থাৎ একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে সৎ কাজ করে, এটা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন তথা রোজা রাখাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ যদি তোমরা জানতে।’ অতিশয় কষ্ট বলতে অতি বার্ধক্য, চিরস্থায়ী রোগ যা অতীব কষ্টকর, তার জন্য ওই মাসে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। পরে কাজা আদায় করলেই চলবে। রোজা রাখায় প্রাণের আশঙ্কা আছে, এ কথাটি কোনো আলেম এবং ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। গর্ভবতী মহিলার যদি গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা হয় অথবা স্তন্যদায়ী মা যদি রোজা দ্বারা তার নিজের বা তার স্তন্যপানকারী শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে সেও এই মাসে রোজা না রেখে পরে সুবিধামতো সময়ে কাজা আদায় করতে পারে। আবার অতিশয় বৃদ্ধের জন্য রোজা পালন জরুরি নয়। ইসলামে দুর্বল, বৃদ্ধ, নিরাময়হীন অসুস্থ, বার্ধক্যের কারণে দুর্বল নর-নারীর রোজা না রাখা বৈধ। বয়স বাড়লে শারীরিক দুর্বলতা হতে পারে, তবে সামর্থ্য থাকলে বয়সের অজুহাতে রোজা ভাঙা ঠিক হবে না। কেউ সফরে থাকলে সে ব্যক্তি রোজা থেকে বিরত থাকতে পারেন। সফর বা দূরত্ব সম্পর্কে ফেকাহবিদের কাছ থেকে আগেই ধারণা নিতে হবে, এর একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব ও সময় বিবেচনায় রাখতে হবে। যেন তেন সফরের দোহাই দিয়ে রোজা থেকে বিরত থাকা অনুচিত। তবে রোজা পালন করতে অপারগ হলে ওই ব্যক্তি অন্য কাউকে দিয়ে কাজা আদায় করাবে বা ফিদিয়া দেবে। মৃত্যুমুখী বৃদ্ধ অথবা এমন রোগে আক্রান্ত হলে, যা থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এমন অক্ষম ব্যক্তি প্রতিটি রোজার পরিবর্তে পৌনে দুই সের গম (ফিতরার পরিমাণ) অথবা সমপরিমাণ মূল্য আদায় করবে। ইসলামের পরিভাষায় এটাকে ফিদিয়া বলা হয় (জাওয়াহিরুল ফিকাহ : খ. ১, পৃ. ২৯)। রোগের কারণে ডাক্তার যদি বলে, এই রোজার কারণে রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বা সুস্থতা বিলম্বিত হতে পারে, তাহলে রোজা ভাঙা যায়। কিন্তু

সামান্য অসুখ, সর্দি-কাশি, অনুরূপ কোনো সাধারণ রোগ-বালাইয়ের কারণে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ নয়।

কোন কোন চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোজা ভাঙে না : রোজার সময় একজন মুসলিমকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গ্রহণ এবং মুখে ওষুধপত্র খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। অনেক সময় রোগীরা একদিকে যেমন রোজা রাখতে চান, তেমনি অন্যদিকে রোগের কারণে বিভিন্ন ওষুধপত্র সেবন করাটাও বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, যেটা না করলে তার জীবন বিপন্নও হতে পারে রোজা রাখা অবস্থায় অনেক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অপারেশনও জরুরি হয়ে পড়তে পারে। যেমন ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দেওয়া, ইনহেলার, রক্ত পরীক্ষা, এন্ডোস্কপি, কোলনোস্কপি, বায়োপসি ইত্যাদি- এগুলো রোজাদার রোগীর জন্য জরুরি হয়ে পড়তে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের দিনের বেলায় রক্ত পরীক্ষা করাসহ কোনো  ইনজেকশন, ইনসুলিন বা টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হয় না। (ফাতাওয়ায়ে ওসমানি : ২/১৮৬)। রোগীর চামড়া, মাংস, অস্থিসন্ধি ও শিরায় ইনজেকশন দেওয়া যাবে। রোগের কারণে শরীরে স্যালাইন নেওয়া যাবে। রোজা ভাঙবে না। (আল ইসলাম ওয়াতিব্দুল হাদিস, ২৮৫)। রোজা অবস্থায় রক্ত দিলে বা নিলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না (ফাতহুল কাদির : ৪/৩২৭)। পরীক্ষার জন্য রোগীর শরীর থেকে রক্ত নেওয়া যাবে। নাকে স্প্রে বা হাঁপানি রোগীরা ইনহেলার ব্যবহার করতে পারবেন। কোনো রোগী মেডিসিন ছাড়া অক্সিজেন অথবা অজ্ঞানকারী গ্যাস নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না (জাদিদ ফেকহি মাসায়েল : ১/৮৮)। রোজা অবস্থায় চোখ কান ও নাকে ড্রপ ব্যবহার করা যাবে। যদি ওষুধের স্বাদ মুখে অনুভুত হয় সেক্ষেত্রে তা ফেলে দিয়ে কুলি করে ফেলা উচিত (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি : ১/২০৩)। চর্মের মলম, ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী হার্টের এনজিওগ্রাম এবং কার্ডিয়াক ক্যাথেটার করা যাবে। ডায়ালাইসিস করলে রোজা ভাঙবে না। মুখ পরিষ্কারে মাউথ ওয়াশ বা গড়গড়া বা স্প্রে জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে,  তবে যেন পাকস্থলিতে না যায়।

লেখক : ইউজিসি অধ্যাপক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর