বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ম্যাজিক এবং মস্তিষ্ক : ম্যাজিক মনস্তত্ত্ব

ম্যাজিক এবং মস্তিষ্ক : ম্যাজিক মনস্তত্ত্ব

ম্যাজিক! জাদু! আমাদের সবার ভালো লাগে। মুহূর্তে মুগ্ধ হয়ে যাই আমরা। কিন্তু কেন মুগ্ধ হই, ম্যাজিক কেন আমাদের ভালো লাগে? হাজার বছর ধরে জাদুর নাম করে ম্যাজিক যে একটি কৌশল এবং এই কৌশলে আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্ককে কি করে রাজি করে, তার একটি মনস্তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ জরুরি।

ম্যাজিক একটি আর্ট। জাদু একটি পরিবেশন শিল্প। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে নিউরো গেম। ম্যাজিকের কাজ মস্তিষ্কে নিউরনের খেলা।

ম্যাজিকের জন্ম বলা হয় দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগে। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, তারও আগে ম্যাজিক ছিল! কিন্তু ম্যাজিক একটি আর্ট-এটি নিয়ে প্রথম লিখেন Osthanes । খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশো বছর আগে। খ্রিস্ট-পরবর্তী প্রথম শতাব্দীতে রোমান লেখক প্লিলনি উল্লেখ করেন যে প্রাচীন পার্সিয়াতে জোরাস্তান সর্বপ্রথম ম্যাজিকের প্রচলন করেন। কিন্তু সময়ে ধীরে ধীরে ম্যাজিক প্রদর্শনের ক্ষমতা মধ্যযুগে কমতে থাকে। মানুষ তার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। ম্যাজিক হয়ে উঠলো একটি বিনোদন, ক্রীড়া এবং একটি আর্ট। ম্যাজিক শুরুতে ছিল সাইকোলজি অব মিরাকল। কিন্তু বিজ্ঞান এবং সাইকোলজির হাত ধরে এটি হয়ে ওঠল সাইকোলজি অব ডিসেপশন। ক্রমে ম্যাজিক হয়ে ওঠল ক্ষণিকের জন্য কৃত্রিম বিশ্বাস। সে জানে এটি সত্য নয়, কিন্তু ক্ষণিকের কৃত্রিম বিশ্বাস তাকে আনন্দ দেয় বলে সে মস্তিষ্ককে সেটির সিগন্যাল দেয়। মানব ইতিহাসের বিবর্তন এবং পরিবর্তনে এ ম্যাজিকের ম্যাজিকেল একটা পরিবর্তন আছে। ম্যাজিক হলো মাইন্ড গেম। ম্যাজিশিয়ানরা খেলে দর্শকদের মাইন্ড নিয়ে। বিভিন্ন ট্রিকের মধ্য দিয়ে এটা সে করে। অবাক হলে মানুষ আনন্দ পায়। কি করে সে অবাক হলো সেটি আর সে ভাবে না। দেখছে সে একটি খালি গ্লাসের ভিতর একটি রুমাল ঢুকল। চোখের পলকেই রুমাল উধাও হয়ে গেল। গ্লাসের ভিতর দেখা যাচ্ছে আস্ত একটি ফুল। যা ভাবতে পারেনি বা আশা করেনি, তেমন কিছু দেখলে মস্তিষ্ক যেন একটি ধাক্কা খায়। বিস্ময় হয়। যা ছিল অসম্ভব, তা কি করে সম্ভব হলো, মাথা তার হিসাবে মেলাতে পারে না। ম্যাজিককে কিছু ট্রিক বা কৌশলের রপ্ত করা খেলার পরিবর্তে বলা যায় হেকিং অব মাইন্ড। কৌশলে ম্যাজিশিয়ান আমাদের মাইন্ড হেক করে। আমাদের মন চুরি করে নেয়। অথচ মনে হয় সত্যটাই আমরা দেখছি। চোখের সামনেই দেখছি অসম্ভবটুকু হয়ে গেল সম্ভব। রুমাল হয়ে গেল গোলাপ। তাহলে নিত্য আমরা অন্য সময়গুলোতে যা কিছু ভাবি, দেখি, শুনি এবং যাকে রিয়েলিটি মনে করে নিশ্চিত হয়ে নেই, সেখানেও কি আমাদের মন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের চোখ বোকা হতে পারে? ম্যাজিকের ট্রিকে মস্তিষ্ক যদি ভ্রমকে রিয়েল ভেবে বসে, তেমনি নিত্য চিনার দেখার কাজেও আমাদের এমন ভ্রম ঘটতে পারে। ম্যাজিক অব সাইকোলজি কিংবা সাইকোলজি অব ম্যাজিক  মানব মনের এই রহস্যকে বুঝতে সাহায্য করে। ম্যাজিক হচ্ছে আমরা যা দেখি এবং যা দেখি না তার একটি মিশ্র ইলুশন। চিন্তা বোধের প্রক্রিয়ার কোনো একটি বিরতি অথবা অসংগতির ফাঁক দিয়ে ম্যাজিশিয়ান আমাদের দৃষ্টি কখনো চুরি করে নেয়, কখনো দৃষ্টি ভুল দিকে সরিয়ে নেয়। আর এই বিরতিটুকুতেই বিস্ময়টুকু সামনে নিয়ে আসে। তাহলে বলা যায় ম্যাজিক হলো মস্তিষ্কের কগনিটিভ ক্ষমতার একটি ত্রুটি। আমরা দিব্য চোখে জিনিসটি দেখছি সামনে। কিন্তু একই জিনিস মুহূর্তেই দেখছি পরিবর্তন হয়ে গেল। তার মানে শুরুতে নিশ্চয়ই আমাদের দেখার মধ্যে কোনো ফাঁক ছিল গন্ডগোল ছিল, যা বাস্তব মনে করে দেখছিলাম সেটাই আসলে বাস্তব ছিল না। কিন্তু যাকে বাস্তব ধরে পরিবর্তিত ম্যাজিক যা করল তাকেই আবার বাস্তব ধরে বসে মন। তার মানে দুই ক্ষেত্রেই মন চোখ মাথা প্রতারণার শিকার হয়। এই প্রতারণা কি ম্যাজিশিয়ান করে নাকি আমাদের মস্তিষ্ক করে! তার মানে আমরা যা কিছু নিত্য দেখি, তার মধ্যে গ্যাপ আছে। আমাদের কনসাস থট প্রসেসের যাকে আমরা যতটুকু রিয়ালিটি ভাবছি, আসলে সেটা ততটুকু রিয়ালিটি না। যেটা বাস্তবে সামনে সেটা যেমন পুরোপুরি আমরা দেখছি না, তেমনি যেটা আমরা ভেবে নিচ্ছি বাস্তব, সেটাও বাস্তবে আসলে অতটা নয়। আমরা দাবি করি আমাদের বোঝায় হয়তো গলদ থাকতে পারে, কিন্তু দেখায় কোনো গলদ নেই। অথচ ম্যাজিক হলো ঠিক দেখার গলদ। এটি মুহূর্তেই ঘটে। ম্যাজিশিয়ান সেকেন্ডে দৃষ্টি ভ্রম ঘটায়, আপনি মনোযোগ আপনার অজান্তেই অন্যদিকে সরিয়ে নেন অথবা সরে যায়। আমাদের অভিজ্ঞতার যতটাকে আমরা অভিজ্ঞতা বলে জানি, বুঝি কিংবা মনে করি, আসলে তা বিভ্রম।

-ডা. অপূর্ব চৌধুরী, চিকিৎসক, ইংল্যান্ড।

সর্বশেষ খবর