সোমবার, ২৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্যের নানা জটিলতা

ডা. আমিনুল ইসলাম

করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্যের নানা জটিলতা

করোনা থেকে আরোগ্য লাভের সপ্তাহ দুয়েক পর তার বুক যেন চেপে আসছিল। মনে হচ্ছিল, কয়েক টন পাথর যেন তার বুকে কেউ বেঁধে দিয়েছে- আগের মতো আর বুকভরে শ্বাস নিতে পারে না। গলাব্যথা, মুখ শুকিয়ে যায়, হাত-পা ঝিঝি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, বসা থেকে দাঁড়ালে বা একটু পরিশ্রম করলে বুক ধড়ফড়ানি, রাতে ঘুমের দৈন্যদশা, কখনো ঘুমের মধ্যে যেন পানিতে ডুবে যাচ্ছে এমন দমবন্ধ অবস্থা। এ এক বিষণ্নকারী দশা। কিছু দিন ভালো থাকার পর আবার তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সামান্য হাঁটলেই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সে ভেবে পায় না আবার আগের জীবনটা ফিরে পাবে কি না। কোনো ইনফেকশন আর নেই তবু রোলার কোস্টারের মতো এই ভালো এই খারাপ জীবনটা যেন সঙ্গী হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ ঠিকঠাক হাঁটতে পারে, কাজ করতে পারে তো পরের সপ্তাহেই আবার কাত। ইলেকট্রিক সুইচের মতো অন-অফ যেন জীবনের অন্য দ্যোতনা হয়ে গেছে। সুগার, কোলেস্টেরল, প্রেসার আগে সব স্বাভাবিক ছিল, করোনার পর এলোমেলো। ইসিজিতে হার্টের ছন্দ স্বাভাবিক থাকে না সব সময়। হার্ট রেট এমনকি দেড়শ-দুই’শ হয়ে যায় হঠাৎ করে, এমনকি সুস্থ হয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরেও অক্সিজেন saturation কিছুটা কমতে থাকে বিশেষ করে বসা থেকে দাঁড়ালে। মাথা হঠাৎ হালকা লাগা, মনঃসংযোগের সমস্যা, স্মৃতিভ্রষ্টতায় হঠাৎ করেই মন-মস্তিষ্ক যেন ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। বিশ্বব্যাপী এমন এক উদ্বিগ্নতা কাজ করছে যে মহামারী চলে যাওয়ার পরও কোনো কোনো কভিড সারভাইভারকে ‘এ অনন্ত সংশয়ে আর পারি না ঝুঝিতে’ এর মতো সংগ্রাম করে যেতে হবে। কেউ জানে না কতদিন। রোগটি এতই নতুন- এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কী হবে এ নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকার দূর হয়ে যায়নি এখনো। প্রলম্বিত সমস্যাগুলোর জন্য কাউকে আইসিউতে যাওয়া বা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকতে হবে ব্যাপারটা তেমন নয়। মৃদু সংক্রমণের পরেও কেউ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ফাঁদে পড়তে পারে। সব ভাইরাল মহামারীর পরই কিছু দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত থেকে যায়। ২০১৪-২০১৬ এর ইবোলা মহামারীর পর পশ্চিম আফ্রিকানদের মধ্যে দুর্বলতা, মাথাব্যথা, গা ব্যথা, জয়েন্ট পেইন, স্মৃতিভ্রষ্টতা, ঘন ঘন প্রস্রাব- এ ছয়টি সমস্যা দীর্ঘদিন বিরাজ করেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলম্ব হলেও সেগুলো প্রায় সব চলে গেছে।  SARS করোনাভাইরাস থেকে দেখা গেছে, সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও তার আঘাত কয়েক বছর ধরে ছিল। ২০১১-তে টরেন্টো ভার্সিটির দুজন গবেষক দেখিয়েছেন বেশকিছু রোগী ১৩ থেকে ৩৬ মাস পরেও কাজকর্মে পুরোপুরি সক্ষম ছিলেন না। তাদের সমসাময়িক সমবয়সীদের চেয়ে বিষণ্নতা, গা ব্যথা, ক্লান্তি, নিদ্রার সমস্যা ছিল বেশি।  SARS আক্রান্ত রোগীদের চার বছর ধরে ট্রেক করে ২০০৯ এই প্রকাশিত আরেক স্টাডিতে দেখা গেছে ৪০ ভাগের চোরা স্রোতের মতো দীর্ঘস্থায়ী শ্রান্তি অবসাদ  (Chronic Fatigue)। এ atigue বা ব্যাখ্যাহীন দুর্বলতার রোগ নিরূপণে কোনো ব্লাড টেস্ট নেই। প্রায় সময়ই রোগীকে বলে দেওয়া হয় এটা কোনো ব্যাপার না, কিন্তু কোনো পরীক্ষায় ধরা না পড়ুক, কেউ বিশ্বাস না করুক, রোগী নিজে তো জানে তার বেদনাটা বাস্তব। তাদের অনেকে কাজ হারিয়ে হয়ে গিয়েছিল বেকার, সমাজে হয়েছিলstigmatized। ইতালির রোমে সম্প্রতি ১৪৩ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া কভিড রোগীর ওপর স্টাডি করে দেখা গেছে দুই মাস পরেও তাদের ৫৩% ক্লান্তিতে, ৪৩% শ্বাসকষ্টে ভুগছে। চীনে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে তিন মাসের মাথায় ২৫% এর লিভার ফাংশন এবনরমাল, ১৬% ভুগছে বিষণœœতায়।

কীভাবে ভাইরাস এটা দীর্ঘদিন যাবৎ করে যায় সেটা নিয়ে পুরো ধারণা এখনো পরিষ্কার না। ২০১৭ তে প্রকাশিত এক রিভিউতে দেখা গেছে তুষের আগুনের মতো হালকা মাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ দীর্ঘদিন চলতে থাকে। তাই মুক্তি মেলে না সহজে জড়ালে ভাইরাসের জালে। আর সেটা যদি হয় করোনাভাইরাস!

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

সর্বশেষ খবর