শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস

ডা. আরিফ মাহমুদ

ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নির্ণয় করা গেলে বেশির ভাগ ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে।  তার জন্য চাই সচেতনতা

 

শুরু হয়েছে ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস। অক্টোবর মাসব্যাপী পালন করা হয় এই সচেতনতা; এটি একটি বার্ষিক প্রচার যাতে ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে মানুষদের বিশেষভাবে জানানোর জন্য করা হয়। এ মাসে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা হয়। বিশেষ করে নারীদের যে, ‘নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের যত্ন নিন, নিজেকে নিয়ে সচেতন হোন’।

প্রথম এ মাসটি পালন করা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। নারীদের কান্সারের মধ্যে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সার। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নির্ণয় করা গেলে বেশির ভাগ ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে। তার জন্য চাই সচেতনতা।

বৈশ্বিক মহামারী করোনায় সবাই পর্যুদস্ত, ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে এ বছর পালিত হচ্ছে এই মাসটি। এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘একা নয়, একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারকে জয় করতে হবে।’ সচেতনতার প্রতীক হিসেবে মাসব্যাপী পরিধান করতে হয় পিংক রিবন। এর উদেশ্য হচ্ছে :

১। যারা এ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, তাদের সম্মান জানানোর জন্য, এছাড়া শ্রদ্ধা নিবেদন করা।

২। যারা এ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তাদের স্মরণ করার জন্য, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা।

৩। যারা এ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত আছেন, যারা এটা মোকাবিলা করার জন্য নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য, তাদের সহযোগিতা করা।

পরিসংখ্যান বলেছে, এ বছর ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন ২ লাখ ৬৮ হাজার ৬০০ জন নারী ও ২ হাজার ৬০০ পুরুষ। একমাত্র সচেতনতাই পারে এ বিশাল সংখ্যাকে কমিয়ে আনতে। এ বছরের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী পরিবারের একজন, আরেকজনকে সহযোগিতা করতে হবে। পরিবারের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ রোগকে প্রতিরোধ করা। ব্রেস্ট ক্যান্সারে নারীর পাশাপাশি পুরুষরাও আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু সম্ভাবনা অনেক কম প্রতি ৮০০ জন পুরুষের মধ্যে ১ জনের আক্রান্তের শঙ্কা থাকে। সুতরাং সবাইকে সচেতন হতে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি :

অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি: ১. পুরুষেরও ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে, তবে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ১০০ গুণ।

২. বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে, পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর ঝুঁকি বেশি বাড়ে। তবে অজানা কারণে আমাদের দেশে ৪০-এর পরই বেশি দেখা যায়।

৩. জিনগত: বিআরসিএ-১ ও ২ জিনের অস্বাভাবিক মিউটেশন ৫ থেকে ১০ শতাংশ দায়ী ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য।

৪. বংশগত: কারও পরিবারের কোনো নিকটাত্মীয় যেমন- মা, খালা, বড় বোন বা মেয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তার ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।

৫. পিরিয়ড: যেসব নারী ১২ বছর বয়সের আগে পিরিয়ড শুরু এবং ৫০ বছর বয়সের পর পিরিয়ড বন্ধ হয়, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি:

১. সন্তান সংখ্যা: নিঃসন্তান নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।

২. বেশি বয়সে সন্তান: ৩০ বছর বয়সের পর বিয়ে ও প্রথম সন্তানের মা হওয়া ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৩. ব্রেস্টফিডিং না করানো: সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানোর অভ্যাস ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. খাদ্যাভ্যাস: শাকসবজি ও ফলমূল কম খেয়ে, চর্বি ও প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।

৫. ওজন: অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক পরিশ্রমের অনভ্যাস ঝুঁকি বাড়ায়।

অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, ব্রেস্টে সাধারণ কোনো চাকা বা পি- থাকা ইত্যাদি।

ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয় :

১। ক্যান্সার প্রতিরোধী খাবার খান : বেশি আঁশযুক্ত খাবার ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমাতে পারে। এর ফলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% পর্যন্ত কমে। মটরশুঁটি, তাজা ফল, আস্ত শস্য এবং ফ্ল্যাভনয়েড, ক্রুসিফেরাস ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট (ব্রোকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি) ও ক্যারোটিনয়েডসমৃদ্ধ সবজি খান। পিঁয়াজ, রসুন, পিঁয়াজ পাতা ইত্যাদি সবজি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ফ্রি র‌্যাডিকেলকে নিরপেক্ষ করে এবং ক্যান্সার কোষের বিভক্ত হওয়া প্রতিরোধ করে। এ ধরনের সবজি কাঁচা খেলেই সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।

২। শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন : যেসব নারী দৈনিক ৩০-৪৫ মিনিট ব্যায়াম করেন তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি যারা ব্যায়াম করেন না তাদের চেয়ে ২০-৪০% কমে।  প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সাধারণ ব্যায়াম যেমন- দ্রুত হাঁটার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।

৩। ওজন ঠিক রাখুন : গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক ওজন ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। ক্যান্সার ও ওজনের এ সম্পৃক্ততার জন্যই সবার উচিত দেহের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা।

৪। নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট : অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করা যায়। পর্যাপ্ত মাত্রার ভিটামিন এ, ডি ও ই ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫। গ্রিন টি পান করুন : গ্রিন টিতে ইজিসিজি (এপিগ্যালোক্যাটেচিন-৩-গ্যালেট) নামক উপাদান থাকে যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে বন্ধ করতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন গ্রিন টি পান করুন।

৬। ভালো ফ্যাট গ্রহণ করুন : বিভিন্ন ধরনের চর্বি ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই খারাপ ফ্যাট বর্জন করে ভালো ফ্যাট গ্রহণ করা উচিত।

৭। ধূমপান বর্জন করুন : যেসব নারী ধূমপান করেন বা ক্রমাগত পরোক্ষভাবে ধোঁয়ায় আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৪০%এরও বেশি। যাদের অ্যালকোহল সেবনের অভ্যাস আছে তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। যদি এ অভ্যাসগুলো আপনার থাকে তাহলে পরিত্যাগ করার চেষ্টা করুন।

ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর কারণ হিসেবে সারা বিশ্বে ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়।

লেখক : ডেপুটি ডিরেক্টর, মেডিকেল সার্ভিসেস, এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা।

সর্বশেষ খবর