মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ওমিক্রন : নতুন আতঙ্ক

ডা. আরিফ মাহমুদ

ওমিক্রন : নতুন আতঙ্ক

ধীরে ধীরে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ করোনার টিকা পাচ্ছিলেন, দুই বছরে করোনা মহামারীর দু’টি ঢেউয়ের পর ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার কমে আসছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় আবারও মুখরিত হচ্ছিল, অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্ববাসী যখন অন্ধকারাময় দিন কাটিয়ে আবার কভিড-পূর্ব পৃথিবীতে (New Normal) ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময় বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন গতকাল পর্যন্ত ৩৯টি দেশে ছড়িয়েছে। ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হয় আফ্রিকার দেশ বোতসোয়ানায়। এরপর আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। নতুন ধরনটি কতটুকু শক্তিশালী, মানবদেহে কতটুকু ক্ষতি করে, উৎপাদিত করোনার টিকা এ ধরনের বিপক্ষে কার্যকরী বা নিরাপদ কিনা- এসব নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা, গবেষণা বসে গেছে তথ্য অনুসন্ধানে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে। WHO-এর প্রধান মি. টেড্রস আধানম গ্যাব্রিয়েস সব দেশকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে বলেছেন। এ ধরনের পুরোপুরি চিত্র ও তথ্য পেতে দুই সপ্তাহের মতো সময় প্রয়োজন। তারপরই এ ওমিক্রন মোকাবিলার প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপ বা রণকৌশল ঠিক করা হবে। এ ধরন প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মি. টুলি ও টি আলজেরিয়া বলেন, অস্বাভাবিকভাবে এটি রূপান্তরিত হয়েছে এবং অন্য যে কোনো ধরন থেকে এটি আলাদা। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ৫০ বারের মতো জিনবিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে নতুন ওমিক্রন ধরন রূপ পেয়েছে, আর স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য বদলেছে অসংখ্যাবার। সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে কমপক্ষে ৭০টি দেশ ও অঞ্চল আফ্রিকার বেশকটি দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনার এ নতুন ধরনকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

সব মিলিয়ে ৫০ বারের মতো জিনবিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে নতুন ওমিক্রন ধরন রূপ পেয়েছে, আর স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য বদলেছে অসংখ্যবার।

উপসর্গসমূহ : দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসক ড. অ্যাঞ্জেলিক কোয়েটজি বলেন, ওমিক্রনের উপসর্গ খুব মৃদু। চিকিৎসকদের মতে ওমিক্রনের কিছু লক্ষণ রয়েছে যা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনে আক্রান্ত রোগীদের দেহে খুবই হালকা উপসর্গ থাকে এবং বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করা সম্ভব। উপসর্গসমূহ : ১। ক্লান্তিবোধ করা ২। গায়ে ব্যথা ৩। মাথা যন্ত্রণা ৪। ভাইরাল ফিবারের মতো লক্ষণ ৫। বেশিরভাগ রোগীর বয়স ৪০ বা এর কাছাকাছি ৬। অক্সিজনের মাত্রা কমে না ৭। নাকে স্বাদ-গন্ধ যায় না

করোনার টিকা কী কাজ করবে :

১। মার্কিন সংস্থা ফাইজার এবং তাদের জার্মান পার্টনার বায়োএনটেক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে- তাদের বর্তমান টিকা করোনার নতুন রূপের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ওমিক্রন ধরনের বিরুদ্ধে একটি নতুন টিকা তৈরি করতে পারবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২। মডার্না এরই মধ্যে নতুন ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর বুস্টার ডোজ বানানোর কাজ শুরু করেছে। ৩। জনসন অ্যান্ড জনসন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নতুন টিকা উদ্ভাবনের ঘোষণা দিয়েছে।

আমাদের করণীয় : এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে বসবাসকারীদের এ মুহূর্তে দেশে আসার পরিকল্পনা বাতিল করতে বলেছেন। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর ১৫টি দিক নির্দেশনা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেছেন।

১। দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি, লেসোথো এবং ডব্লিউএইচও সামনে যেসব আক্রান্ত দেশের নাম ঘোষণা করবে; সেসব দেশ থেকে আগত যাত্রীদের বন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। ২। সব ধরনের (সামাজিক/ রাজনৈতিক/ ধর্মীয়/ অন্যান্য) জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। ৩। প্রয়োজনে বাইরে গেলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাড়ির বাইরে সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ৪। রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম করতে হবে। ৫। সব ধরনের জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল/থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বউভাত, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতে পারবে।

৬। মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।

৭। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ৮। আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। ৯। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মাদরাসা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ও কোচিং সেন্টারে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ১০। সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবাগ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ১১। স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ১২। করোনার উপসর্গ বা লক্ষণযুক্ত সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগীর আইসোলেশন ও করোনা পজেটিভ রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ১৩। করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা এবং তাঁর নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে সহায়তা করা যেতে পারে।

১৪। অফিসে প্রবেশ ও অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দাফতরিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

১৫। করোনা নিয়ন্ত্রণ ও কমানোর জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং ও প্রচার চালানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার মাইক ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এ সময় আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সচেতন হতে হবে।

পরামর্শ : অবহেলা না করে সবাইকে অবশ্যই সঠিক নিয়মে নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। সাবান পানি/ হ্যান্ড র‌্যাব দিয়ে হাত ধুতে হবে। সামাজিক/ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তথ্যসুত্র : WHO, CNN, DG Health, Nature Journal.

লেখক : ডেপুটি ডিরেক্টর, মেডিকেল সার্ভিসেস, এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর