সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ইফতার-পরবর্তী হার্ট অ্যাটাক নিয়ে শোরগোল ও কিছু কথা

ডা. মাহবুবর রহমান

ইফতার-পরবর্তী হার্ট অ্যাটাক নিয়ে শোরগোল ও কিছু কথা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোজার সময় ‘ইফতার-পরবর্তী হার্ট অ্যাটাক’ নিয়ে বেশ শোরগোল শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, ইফতারের পর দেশে হার্ট অ্যাটাক অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কোথায় কখন কিভাবে বেড়েছে- সেটা নিয়ে আর কেউ লিখছেন না। শুধু শেয়ার করে যাচ্ছেন ইফতার-পরবর্তী হার্ট অ্যাটাক কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। অথচ এর কোনো সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যানও নেই। এটাও ঠিক যে সবাই ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই এ বিষয়টি শেয়ার করছেন। কিন্তু সবাই যেভাবে শেয়ার করছেন, এতে একটা প্যানিক সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, এটাও স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের দেশে রোজার সময়ের যে খাদ্য তালিকা অনুসরণ করা হয়- তা কোন ভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বিশেষ করে ভাজাপোড়া, হঠাৎ করে ইফতারের সময় অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল নয়। রেড মিট- যেমন গরু, খাসি ও হাঁসের মাংস অতিরিক্ত কোলেস্টেরল বহন করে বিধায় হার্টের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ইতিমধ্যেই যাঁরা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা অবশ্যই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করবেন। রোজার সময়ে মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, ওষুধ গ্রহণের সময়সূচি, ঘুমের সময় ও পরিমাণ পরিবর্তিত হয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক মানুষ যেভাবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তা একজন অসুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই এ বিষয়ে কিছু বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

প্রায়শই দেখা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা ও কিডনির অক্ষমতা পাশাপাশি অবস্থান করে। ফলে রোজার সময়ে খাদ্যাভ্যাস ও ওষুধপত্র নতুন করে সময়োপযোগী করে নিতে হবে।

১। যাঁদের হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কম (  LVEF 25% এর নীচে) তাঁদের রোজা না রাখাই ভাল।

২। যাঁদের বয়স ৭০ এর ওপরে , হার্ট দুর্বল, ডায়াবেটিস আছে, কিডনির সমস্যা আছে- তাঁদেরও রোজা না রাখাই ভাল। ৩। যে সব হৃদরোগীর হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা স্বাভাবিক তাঁরা অন্য সবার মত রোজা রাখতে পারবেন। ৪। হৃদরোগীদের সাধারণত কয়েকটি ওষুধ নিয়মিত খেয়ে যেতে হয়। বেশির ভাগ ওষুধ দিনে একবার বা দু’বার খেলেই হয়। যেসব ওষুধ দিনে একবার খেলে চলে রোজার সময় সেগুলো রাতের খাবারের সময় নিলেই চলবে। যেসব ওষুধ দিনে দু’বার খেতে হবে সেগুলো ইফতার ও সেহরির সময় খেলে চলবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন দুই ডোজের মধ্যবর্তী সময়টি সংক্ষিপ্ত না হয়। বিশেষ করে প্রেসারের ওষুধ পর্যাপ্ত ফারাক (space) দিয়ে সেবন করতে হবে। রোজার সময়ে খাদ্য ও পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় প্রেসার কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মাত্রা কমানো যেতে পারে। হৃদরোগের কিছু কিছু ওষুধ (যেমন Nitrate) সকালে ও বিকাল খেতে হয়, রোজায় সেগুলো সাহরি ও ইফতারের সময়ে সমন্বয় করা যায়। কিছু ওষুধ দিনে তিনবার নিতে হয় (যেমন Diltiazem), সেগুলো স্লো রিলিজ ফর্মে দিনে একবার বা দু’বারে খাওয়া যায়।

৫। হৃদরোগীদের মধ্যে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে তাঁদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। দিনের দীর্ঘ সময় খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করায় রক্তে সুগারের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে বা মাথা ঝিমঝিম করলে, বুক ধড়ফড় করে প্রচুর ঘাম দিলে সুগারের মাত্রা কমে যেতে পারে বলে সন্দেহ করতে হবে। এবং তৎক্ষণাৎ সুগার পরীক্ষা করা সম্ভব হলে করতে হবে। পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে হাতের কাছে চিনি জাতীয় যা কিছু পাওয়া যায় দ্রুত খেয়ে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। পরবর্তীতে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করতে হবে। তবে রোজার সময় যেসব ওষুধ দ্রুত রক্তের সুগার কমায় তা এড়িয়ে চলা উত্তম। ইনসুলিনের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ইনসুলিনের মেজর অংশটি ইফতারের সময় নিলে ভালো, আর স্বল্প মাত্রাটি সাহরির সময় নিতে হবে যাতে দিনের দীর্ঘ সময়ে সুগার কমে না যায়। তাই প্যানিক না হয়ে  এসব বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।

লেখক : সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর