এ বছর মানে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে গরমের তীব্রতা অন্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রচন্ড গরমে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণগুলো হচ্ছে গরমে বিপাকীয় কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পাওয়া, পানি ও লবণ ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে শরীরে লবণ পানির ঘাটতি ঘটানো, স্নায়ুবিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে অস্থির করে তোলা, কাজকর্মে অনীহা সৃষ্টি হওয়া, মেজাজ মর্জি খিটখিটে হয়ে উঠা, কাজকর্মে মনোযোগ কমে যাওয়া, কাজকর্মে সহজেই ভুল করা, অন্যদের সঙ্গে আচার-আচরণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হওয়া ইত্যাদি।
গরমকালে গরমের প্রভাবে রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার সাধারণত কমে যায় তবে যাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় তাদের আবার প্রেসার বেড়ে যেতে পারে। তীব্র গরমের সময় যারা প্রেসারের মেডিসিন গ্রহণ করছেন তাদের মেডিসিনের মাত্রা কমবেশি করার প্রয়োজন হতে পারে তবে তা যেন রোগী নিজের উদ্যোগে না করেন। মেডিসিনের মাত্রা ঠিক করার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারাও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে মেডিসিনের মাত্রা ঠিক করে নিবেন। যারা হার্টের অসুস্থতায় ভুগছেন বা হার্টে ব্লক জনিত সমস্যায় ভুগছেন বা হার্ট ফেইলুরে ভুগছেন তাদের অসুস্থতার মাত্রা গরমের ফলে বৃদ্ধি পেতে পারে। রক্তের তারল্যতা কমে গিয়ে রক্ত ঘন হয়ে যেতে পারে, এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বিশেষ করে হার্টে ও ব্রেইনে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেইন স্ট্রোকের মতো প্রাণঘাতী অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারেন। ব্লাড প্রেসার অত্যধিক মাত্রায় কমে গেলেও হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেইন স্ট্রোক দেখা দিতে পারে। যারা গরমের সময় গুরুতর অসুস্থতায় আক্রান্ত হন তারা ওই সময়ে রক্তচাপ বা প্রেসার অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েও হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। হার্ট ফেইলুরের রোগীদের এমনিতে হার্ট খুব দুর্বল থাকে এবং তারা অধিকাংশই অত্যধিক বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, প্রচন্ড গরমের প্রভাবে পানি ও লবণের ঘাটতি জনিত কারণে হার্ট আরও বেশি দুর্বল হয়ে হার্ট ফেইলুরের তীব্রতা বৃদ্ধি করে একুইট হার্ট ফেইলুরে পতিত হওয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট, বুকেচাপ, বুক ধড়ফড়, বুকব্যথা ইত্যাদি আরও অনেক উপসর্গে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ অবস্থায় রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর না করলে জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যদি কারও হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেইন স্ট্রোকের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো হলো, বুকে প্রচন্ড চাপ অনুভব করা তার সঙ্গে বুকেব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, অত্যধিক ঘাম হওয়া, কারও কারও ঘামে পরনের কাপর ভিজে যায়, বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব হওয়া, মাথা হালকা অনুভূত হওয়া তবে এতে রোগী সাধারণত অজ্ঞান না হয়ে কিছুটা বোধশক্তি কমে যেতে পারে তবে খুব বেশি তীব্র অ্যাটাক হলে কাউকে কাউকে অজ্ঞান হতে দেখা যায়। ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি মাথা হালকা হওয়া এবং অনেকেই খুব তাড়াতাড়ি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। মাথা ঘোরানো, কথা বলতে কষ্ট হওয়া, কাউকে আবোল-তাবোল কথা বলতে দেখা যায়, অনেকের কথা জড়িয়ে আসে, কেউ কথা বলতে পারে না, কারও চোখে দেখতে বা কানে শুনতে অসুবিধায় পড়েন।
কারও মুখ বাঁকা হয়ে যেতে দেখা যায়, কারও কারও হাত-পা অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে, কারও কারও হাত-পা অবশ হয়ে যেতে পারে।
যারা বয়স্ক ব্যক্তি, যারা হাইপ্রেসার বা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, যারা হার্ট ফেইলুরে ভুগছেন, যাদের হার্টে ব্লক আছে, যারা হার্ট ব্লকের জন্য ইতিমধ্যে হার্টে রিং পরেছেন বা হার্টে বাইপাস অপারেশন করেছেন তারা সবাই এই গরমে বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে চলবেন যাতে গরমের কারণে কোনো রূপ বিরূপ অবস্থায় পতিত হতে না হয়। সাধারণত এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে রোগ বৃদ্ধি পেয়ে ব্যক্তির মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
উপরে উল্লিখিত ব্যক্তি যতটা সম্ভব গরম এড়িয়ে চলবেন, খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া রোদে বের হবেন না, তবুও যদি কারও বের হতে হয় তবে রোদ গরম থেকে বাঁচার জন্য ঢিলেঢালা সুতির পোশাক, সঙ্গে ছাতা বা ক্যাপ নিয়ে, বোতলে পানি নিয়ে এবং যারা নাইট্রেট স্প্রে ব্যবহার করেন তা সঙ্গে নিয়ে বের হতে হবে। তবে কোনোভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে রোদে গরমে থাকবেন না। গরমে প্রচুর পানি বা খাবার স্যালাইন খেতে সবাই একটা প্রথাগত পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এ ধরনের স্যালাইন খাওয়া বিপজ্জনকও হতে পারে। গরমে শরীর থেকে যতটুকু পানি বা লবণ বের হয়ে যায় চেষ্টা করতে হবে ঠিক ততটুকু পানি বা খাবার স্যালাইন খাওয়া। অনেকে এখন প্রশ্ন তুলতে পারেন তা কীভাবে পরিমাপ করা যাবে? ব্যক্তির প্রস্রাবের পরিমাণ ও প্রস্রাবের রং দেখে তা অনুমান করা যেতে পারে। প্রস্রাব অল্প পরিমাণে হলে এবং রং গাঢ় হলে বুঝতে হবে পানি বা স্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন আছে, আর যদি প্রস্রাবের পরিমাণ এবং রং স্বাভাবিক থাকে তবে পানি বা স্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি গরমকালে ঘরে থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মেনে চললে ঝুঁকি এড়িয়ে সুস্থ থাকতে পারবেন।
-ডা. এম. শমশের আলী, হার্ট স্পেশালিস্ট, পরিচালক ও চিফ কনসালটেন্ট, শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।