বর্তমান সময়ে বিশ্বে এক নম্বর প্রাণঘাতী অসুস্থতার নাম মাইওকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (এমআই), যাকে সাধারণভাবে হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট স্ট্রোক বলা হয়। হার্টের রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালিকে করোনারি রক্তনালি (আর্টারি) বলা হয়। হার্টে বড় বড় তিনটি করোনারি রক্তনালি থাকে, এর মধ্যে হার্টের বাম পাশে দুটি LAD cI LCX এবং ডান পাশে একটি যাকে RCA বলা হয়। হার্ট একটি মাংস দ্বারা গঠিত থলি বা ব্যাগ। এ থলিতে রক্ত ভর্তি হওয়ার পর থলির চার পাশে মাংসপেশি সংকোচনের ফলে রক্ত পাম্প হয়। এ পাম্পের মাধ্যমে রক্ত, রক্তনালির মাধ্যমে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়। এ প্রবহমান রক্তের মাধ্যমেই সারা শরীরের প্রতিটি অংশে অক্সিজেন ও রসদ (খাদ্য) সরবরাহ হয়ে থাকে। এ রক্ত সরবরাহের জন্য শরীরের প্রতিটি অঙ্গ সঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতা বজায় থাকে এবং প্রতিটি অঙ্গ জীবিত থাকে। যদি কোনো কারণে শরীরের কোনো অংশ রক্ত সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয় তবে সেই অঙ্গ মারা যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। ডায়াবেটিসে অনেক রোগীর পায়ের আঙুলে রক্ত সরবরাহ না পাওয়ার জন্য মরে যেতে দেখা যায়। আঙুলে পচন ধরে এবং প্রায় সময়ই ওইসব আঙুল কেটে বাদ দেওয়া হয়। অনুরূপভাবে শরীরের অন্য সব অঙ্গ রক্ত সরবরাহের অভাবে মরে যেতে পারে বা নষ্ট হয়ে যায়, যা অনেক সময়ই বাইরে থেকে তা দেখা যায় না। হার্টে বড় বড় তিনটি রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ পেয়ে থাকে, যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এসব রক্তনালির মধ্যে যদি হঠাৎ কোনো একটি বা দুটি বন্ধ (ব্লক) হয়ে যায়, তবে হার্টের মাংসপেশির কোনো কোনো অংশ রক্ত সরবরাহ না পেয়ে ওইসব অংশ মরে যায়, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মাইওকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (এমআই) বা হার্ট অ্যাটাক বলা হয়। যারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন, তাদের রক্তনালিতে ব্লক থাকার সম্ভাবনা ৯০ থেকে ৯৯%। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, হার্টের রক্তনালিতে ব্লক ছাড়া হার্ট অ্যাটাক হয় না। যাদের এক বা একাধিকবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তাদের হার্টের রক্তনালিতে অবশ্যই ব্লক আছে এবং এ ব্লকের কারণেই হার্ট অ্যাটাক সংঘটিত হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের ফলে হার্টের এক বা একাধিক অংশ মরে বা অকেজো হয়ে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, হার্টে সুস্থ সবল মাংসপেশির পরিমাণ কমে যায়, ফলে হার্ট দুর্বল হয়ে যায় এবং হার্টের পাম্পিং কার্যক্রম বেশি কমে গেলে ব্যক্তির হার্ট ফেইলুর দেখা দেয় যা অত্যন্ত জটিল একটি অবস্থা। এটা তো গেল যারা হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে থাকেন তাদের পরবর্তী জটিলতার কথা। সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা হলো হার্ট অ্যাটাকের ফলে এক চতুর্থাংশ রোগীর খুব দ্রুত মৃত্যু ঘটে থাকে। যাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়ার পরও বাঁচানো সম্ভব হয় না। যেহেতু হার্ট অ্যাটাক একটি প্রাণঘাতী অসুস্থতা, তাই সচেতন
ব্যক্তিই হার্ট অ্যাটাক থেকে মুক্ত থাকার উপায় অন্বেষণ করে থাকে। মানে কীভাবে হার্ট অ্যাটাককে প্রতিরোধ করা যায়। যাদের হার্ট অ্যাটাক হয় তাদের সবারই আগে থেকে হার্টের রক্তনালিতে ব্লক থাকে, যা কেউ জানেন আবার কারও অজানা থাকে। যাদের অজানা ব্লক থাকে তারা বাহ্যিকভাবে সুস্থ থাকার পরও হঠাৎ অ্যাটাকে আক্রান্ত হন এবং কেউ কেউ তাৎক্ষণিক মৃত্যুমুখে পতিত হন। একটা নির্দিষ্ট বয়স থেকে (৪০ বছর) হার্ট স্পেশালিস্টের শরণাপন্ন হয়ে হার্ট চেকআপের মাধ্যমে ব্যক্তি তার হার্টের অবস্থা জেনে নিতে পারে, যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তবে আগে থেকে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
হার্টবান্ধব সুষম খাদ্য গ্রহণ, যাতে তেল-চর্বির পরিমাণ কম থাকবে, ফলমূল শাকসবজি পরিমাণ মতো থাকবে। নিয়মিতভাবে কায়িক শ্রমের অভ্যাসের মাধ্যমে হার্ট ব্লক থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। যারা উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসারে ভুগছেন তারা প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারা যে কোনোভাবে কায়িক শ্রম, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, মুখে খাওয়ার মেডিসিন এবং প্রয়োজনে ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তা না হলে অবধারিতভাবে আপনি হার্ট ব্লকে আক্রান্ত হবেন। ধূমপান বর্জন, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, দুশ্চিন্তা ও টেনশনমুক্ত থাকা হার্ট ব্লক প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ। ৪০ বছর বয়স থেকে প্রায় সবার হার্টেই ব্লক দেখা দিয়ে থাকে। তবে এসব ব্লকের মাত্রা (পার্সেন্টেজ) যদি কম থাকে, মানে ৫০ পার্সেন্টের কম ব্লক থাকে তবে ব্যক্তি সুস্থ স্বাভাবিকভাবেই জীবনধারণ করতে পারে। এ ব্লকের জন্য ব্যক্তি কোনোরূপ অসুস্থতাবোধ করেন না। তবে যাদের হার্টের রক্তনালিতে অধিক মাত্রায় ব্লক থাকে তারা বিভিন্ন ধরনের অসুবিধাবোধ করে থাকেন- যেমন হাঁটতে বা দৌড়াতে গেলে, ভারী কোনো কাজ করতে গেলে, কোনোরূপ স্টেজফুল অবস্থায় পতিত হলে, অন্য কোনো শারীরিক অবস্থা যেমন জ্বর, ডায়েরিয়া, পানিশূন্যতা, অত্যধিক গরম বা অত্যধিক ঠান্ডা আবহাওয়ায় হার্ট ব্লকের উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। হার্ট ব্লকের উপসর্গগুলো হলো- বুকেব্যথা অনুভব করা, বুকে-পিঠে চাপ অনুভব করা, বুক ধড়ফড় করা, পেরেশান হয়ে যাওয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পাওয়া, এসব উপসর্গ খুব সহজে দূরীভূত হয়ে প্রায় সময়ই কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এ ধরনের ক্ষণস্থায়ী উপসর্গ দেখা দেয় বলে অনেকেই অজ্ঞতাবশত এসব উপসর্গকে গ্যাসের উপসর্গ মনে করে দীর্ঘদিন গ্যাসের ওষুধ সেবন করে এবং জটিল আকার ধারণ করার আগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। অনেক সময় দেখা যায়, রোগী যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় তখন রোগ জটিল অবস্থায় চলে যায়। এসব লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। অন্যথায় জটিলতা বাড়ে।
-ডা. এম শমশের আলী, চিফ কনসালটেন্ট শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।