‘থাইরয়েড হরমোন’ (থাইরক্সিন) সব কাজের কাজি। থাইরক্সিন থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন যার কার্যকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। শারীরিক ও মানসিক সব কর্মকান্ড পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। গলার সামনের দিকে চামড়ার নিচে অবস্থিত গ্রন্থির নাম থাইরয়েড গ্রন্থি, যার থেকে থাইরক্সিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়ে রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেহের সমস্ত কলা ও কোষে পৌঁছে প্রতি কলা ও কোষের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করে। যদি কোনো কারণে রক্তে থাইরক্সিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন সমস্ত শারীরিক ও মানসিক কর্মকান্ডে চঞ্চলতা বৃদ্ধি পায় এবং যদি কোনো কারণে রক্তে থাইরক্সিনের মাত্রা কমে যায় তাহলে শারীরিক ও মানসিক সমস্ত কর্মকান্ড স্তিমিত হয়ে পড়ে। অনেক কারণে থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য বা ঘাটতি দেখা দিয়ে থাকে, তন্মধ্যে অটোইমিউন কারণকে বড় কারণ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, যার সঙ্গে বংশগত প্রভাব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তারমানে বংশে কারও থাইরয়েড সমস্যা থাকলে ব্যক্তিরও থাইরয়েড সমস্যা দেখা দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ভাইরাল ইনফেকশন খাদ্যে আয়োডিনের অভাব, বিভিন্ন ধরনের ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিশেষ করে ভাইরাল ইনফেকশন যেমন ইনফ্লয়েঞ্জা, কভিড-১৯ এবং হার্পিস ভাইরাস, থাইরয়েড অপারেশন, রেডিও থেরাপি, কেমোথেরাপি ইত্যাদি অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম। কারণ যাই হোক না কেন থাইরয়েড সমস্যাকে মূলত দুইভাগে বিবেচনা করা হয়। যেমন থাইরয়েড হরমোন আধিক্য মানে রক্তে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া যাকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলা হয় এবং থাইরয়েড হরমোনের কমতি মানে রক্তে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কমে যাওয়া যাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়ে থাকে।
থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য বা হাইপারথাইর-য়েডিজমে রোগীর শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের কর্মতৎপরতার বৃদ্ধি ঘটে থাকে। ফলশ্রুতিতে রোগীর মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়, কোনো কাজেই মন বসেনা, চিন্তাচেতনায় অস্থিরতা দেখা দেয়, কাজ-কর্ম, চাল-চলন, কথাবার্তায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে দ্রুত কর্মসম্পাদনের প্রবণতা দেখা দেয়। মানসিক অস্থিরতার জন্য ঘুমের ব্যঘাত সৃষ্টি হয়, অতি সহজেই রোগী উত্ত্বেজিত হয়ে পড়ে। উত্ত্বেজনায় হাত-পা-মুখ কাঁপতে থাকা, কথা জড়িয়ে আসার মতো উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। অত্যধিক গরম অনুভূত হওয়া, শরীর অত্যধিক ঘেমে যাওয়া, খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, অত্যধিক ক্ষুধা লাগা, চোখে মুখে চঞ্চলতার ভাব পরিলক্ষিত হওয়া, খুব বেশি ছুটাছুটির প্রবণতা পরিলক্ষিত হওয়া, মাথাব্যথা হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, হার্টের অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য খুব সহজেই বুকের ব্যথায় আক্রান্ত হওয়া, মেয়েদের মাসিকের সমস্যা দেখা দেওয়াসহ আরও অনেক ধরনের উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
থাইরয়েড হরমোনের কমতি বা হাইপোথাইরয়েডিজমে রোগীর মানসিক স্থবিরতা, কর্মতৎপরতা কমে যাওয়া, কাজকর্মে অনীহা, কাজকর্মে চালচলন ও কথাবার্তায় স্থবিরতা দেখা দেয়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ না ঘটা, হাঁটতে বা কথা বলতে দেরি হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। বাচ্চাদের তোতলামোর মতো উপসর্গও দেখা দিয়ে থাকে। বড়দের বেলায় কানে কমশোনা, প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করা বা উত্তর দিতে দ্বিধাবোধ করা, চুপচাপ বসে থাকা ইত্যাদি লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। মাথার চুল ঝরে পড়া, মাথা ব্যথা হওয়া, ক্ষুধা-মন্দা দেখা দেওয়া, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যাওয়া অথচ শারীরিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, বুকে ব্যথা হওয়া, বুকে চাপ অনুভূত হওয়া, ঘনঘন ঠান্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, কোলেস্টেরল বৃদ্ধিজনিত কারণে হার্টের রক্তনালিতে ব্লকের সৃষ্টি হয়ে হৃদরোগের বিভিন্ন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সব সময় ঘুমঘুম ভাব কিন্তু রাত্রে অনিদ্রা হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেওয়া, হাত-পা ও মূখ ফোলাফোলা ভাব পরিলক্ষিত হওয়া, চামড়া খসখসে হয়ে যাওয়া এবং চামড়ায় ফাটল দেখা দেওয়া ও পশম ঝরে পড়া, শরীরে ঘাম কমে যাওয়া বা ঘাম না হওয়ার মতো লক্ষণ রোগের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোগীর ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং অল্প ঠান্ডায় রোগী বেশ কাবু হয়ে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌন দুর্বলতা ও মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধাত্ব দেখা দিয়ে থাকে।
-ডা. এম শমশের আলী, চিফ কনসালটেন্ট
শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।