সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে শিক্ষার মান

আকতারুজ্জামান

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে শিক্ষার মান

দেশের উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বড় ভূমিকা পালন করে আসছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে শিক্ষা সেক্টরে। বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় চাকরিতে নিজেদের স্থান করে নিচ্ছেন গ্র্যাজুয়েটরা। প্রকৌশল আর প্রযুক্তিতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের কোনো ঝামেলাও পোহাতে হয় না ছাত্রছাত্রীদের। তাই অনেকের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর ৩০ বছরের ব্যবধানে দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সূত্র ধরে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমে আসছে। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা জাতীয় উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। দুই দশক আগেও দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন স্বল্পতার কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী লাখ লাখ টাকা খরচ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাড়ি দিতেন। বর্তমানে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েক লাখ ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে। ফলে দেশের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশের তুলনায় কম খরচে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে ছাত্রছাত্রীরা। উচ্চশিক্ষায় দেশের প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত।

তথ্যমতে, একবিংশ শতাব্দীর উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। ইউজিসি সূত্র জানায়, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশের প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ পাস হওয়ার পর ২০১২ সালে ১৬টি, ২০১৩ সালে ১০টি, ২০১৪ সালে ২টি, ২০১৫ সালে ৯টি, ২০১৬ সালে ৫টি, ২০১৮ সালে ৭টি এবং ২০১৯ সালে ২টি এবং ২০২০ সালে ৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ঢাকায় ৫৩টি এবং দেশের অন্যান্য জেলায় ৫৫টিসহ সর্বমোট ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় তিন লাখ ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্নাতক (পাস) পর্যায়ে ১ হাজার ১৬০টি। স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৯৯টি এবং মাস্টার্স পর্যায়ে আসন রয়েছে ৮৯ হাজার ২৯৬টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর এক লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন শ্রেণিতে ভর্তি হন। ইউজিসির সর্বশেষ (৪৭তম) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মোট ৯৯ হাজার ৭৭১ জন ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৮৯ জন।

আকর্ষণীয় বিষয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খোলা হয়েছে আধুনিক যুগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও শিক্ষার্থীদের চাহিদামাফিক নানা বিষয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, আর্কিটেকচার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, পাবলিক হেলথ, ফার্মেসি, ফার্মাসিউটিক্যাল সাইন্স, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি, অ্যাপারেল ম্যানুফেকচারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার, প্রডাক্ট ডিজাইন, মিউজিক, গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, একাউন্টিং, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আইন ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় সহায়ক। এসব বিষয়ে গ্রাজুয়েটরা পেশাজীবনেও অনেক অবদান রাখছেন।

 

আইন মেনে চলছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইন মেনে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি), ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি), আশা ইউনিভার্সিটি  অব বাংলাদেশ, নর্দান ইউনিভার্সিাটি বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সিটি ইউনিভার্সিটি, হামদর্দ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইন মেনে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে।

 

দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস

বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সুবিধা সংবলিত রয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস। তথ্যমতে, সরকার অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমতি প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নির্মাণাধীন স্থায়ী ক্যাম্পাসে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ক্যম্পাস নির্মাণাধীন রয়েছে। নির্মাণ শুরু না করলেও স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য নির্ধারিত জমি ক্রয় করেছে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়। নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণাধীন। ২১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি ক্রয় করেছে। আর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ফাউন্ডেশনের নামে ক্রয়কৃত জমিতে নির্মিত অবকাঠামোতে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে।

 

পরিচালনায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কমিটি

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক কার্যক্রম, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে রয়েছে বিভিন্ন কমিটি। এসব কমিটির মধ্যে অন্যতম, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট ও অর্থ কমিটি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যা দূর করতে বছরে অন্তত একবার সভার আয়োজন করবে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়ন, হিসাব-নিকাশ অনুমোদন, বাজেট অনুমোদনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বোর্ড অব ট্রাস্টিজের। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যাবলি এবং সাধারণ ব্যবস্থাপনা তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃষ্টি, নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত নেওয়া, পরীক্ষা ও ফল অনুমোদনসহ যাবতীয় দায়িত্ব সিন্ডিকেটের। শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সিন্ডিকেটকে সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল।

 

ইউজিসি চেয়ারম্যান যা বললেন

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না থাকলে উচ্চশিক্ষার স্তরে শিক্ষার্থীদের স্থান সংকুলান করা অনেকাংশেই অসম্ভব হতো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার বিস্তারে অনেক কাজ করে যাচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা অভিযোগ, সমালোচনা থাকলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ম মেনে চলছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকেও বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে আসছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হচ্ছে, দেশও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই ভালো করছে।

 

কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেকের

সম্ভাবনাময় খাত দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। ইউজিসি সূত্র বলছে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫ হাজার ২৭৭ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে মহিলা শিক্ষক রয়েছেন ৪ হাজার ৯১৯ জন। শিক্ষকদের মধ্যে পূর্ণকালীন অধ্যাপক রয়েছেন ৮৪১ জন। এদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ৯৫০ জন। এছাড়া মোট ৫ হাজার ৪০০ কর্মকর্তা ও ৭ হাজার ১৮১ জন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর