বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

বিনিয়োগ বাড়াতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নিরসন চাই

বিনিয়োগ বাড়াতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নিরসন চাই

শাহরিয়ার জাহান রাহাত, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কেএসআরএম

নব্বই দশকে একটি মাত্র জাহাজ কিনে ব্যবসার গোড়াপত্তন। সে সময় মাত্র ৫০-৬০ জন কর্মচারী দিয়ে ম্যানুয়াল রড কারখানা গড়েই শুরুটা হয়। বর্তমানে কবির শিল্প গ্রুপের ১২টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৫ হাজার মানুষ। সমুদ্রগামী জাহাজের বৃহত্তম বহরের মালিক এই গ্রুপের অধীনে আছে পাওয়ার প্ল্যান্ট, সিমেন্ট, শিপ ব্রেকিং, শিপ বিল্ডিং, শিপিং অক্সিজেন, জেটি পরিচালনাসহ ১২টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। তবে ইস্পাত খাতই তাদের প্রধান ব্যবসা। ইস্পাত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যান্ড নাম কেএসআরএম। ছুটে চলেছে ‘শেকড় থেকে শিখরে’। চার দশকের অতীত আশ্রয় করে সেই গতিময় ছুটে চলার স্বপ্নযাত্রার কথা জানালেন গ্রুপটির তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত।  বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান রিয়াজ হায়দার চৌধুরী। 

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যবসায় বহুমাত্রিকতা আছে আপনাদের। কীভাবে এলেন এই আজকের অবস্থানে?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কেএসআরএম-এর আজকের অবস্থান। এর পেছনে রয়েছে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিরলস আস্থা ও ভালোবাসা। এ কারণেই সম্ভব হয়েছে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করা।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কীভাবে এত খাতে ব্যবসার সম্প্রসারণ হলো আপনাদের?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : আমাদের প্রধান ব্যবসা ইস্পাত প্রস্তুতকরণ। তবে সময় ও চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের ব্যবসা প্রসারিত করেছি অন্যান্য খাতেও। সেখানেও আমরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছি সমানভাবে।

বর্তমানে শিপিং, পাওয়ার প্ল্যান্ট, সিমেন্ট, শিপ ব্রেকিং, শিপ বিল্ডিং, অক্সিজেন, জেটি পরিচালনাসহ ১২টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রয়েছে কবির গ্রুপের অধীন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশে ব্যবসায় চলমান সংকট ও সরকারের কাছে কোনো দাবি কি আছে?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। নিরসন করতে হবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিনিয়োগের জন্য সব দাফতরিক কাজ এক জায়গায় সম্পন্নের সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন।

বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের এ দফতর থেকে ওই দফতরে ঘুরতে ঘুরতে পেরিয়ে যায় কয়েক বছর। এতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন। যে মনোভাব নিয়ে বিনিয়োগে আগ্রহী হন, তাতে ছেদ পড়ে। যদিও আগের চেয়ে এসব ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। ক্রমান্বয়ে তা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা উচিত। এতে  বিনিয়োগ বাড়বে, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসে’র কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা এবং পরিধিও বাড়ানো অত্যাবশ্যক।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের গল্পটা জানতে চাই...

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : শিল্পে আমাদের উজ্জ্বল অতীত শুরুটা জাহাজভাঙা শিল্প দিয়ে। পরবর্তীতে ইস্পাত প্রস্তুতকারক হিসেবে  আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করি। পাশাপাশি সম্ভাবনাময় সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবসায় যুক্ত হই। সেই ধারাবাহিকতায় ক্রেতাদের আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে আজ আমরা দেশের অন্যতম ইস্পাত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। দেশের সমুদ্রগামী জাহাজের বৃহত্তম বহরের মালিকও আমরা। আমাদের বহরে এখন সমুদ্রগামী বাল্ক ক্যারিয়ারের সংখ্যা ২৩টি।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শুরুটা ঠিক কেমন ছিল?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : ১৯৮৩ সালের ১৩ এপ্রিল আমার দাদা মোহাম্মদ কবির আহমেদের মৃত্যুর পর বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান হাল ধরেন পরিবারিক ব্যবসার। বাবার ছোট্ট কাঁধে চাপে বিশাল পারিবারিক দায়িত্ব। তখন বাবার চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে পদার্পণ। এমন সময় দাদার মৃত্যুতে ঘাবড়ে গেলেও বাবা মোটেও দমে যাননি। কারণ রক্তে তাঁর ছিল সামনে যাওয়ার অদম্য স্পৃহা। দেশ ও সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের নেশা। সেই থেকে শুরু। আর পেছনে তাকানোর সময় পাননি। শুধুই এগিয়ে চলা...।

১৯৮৪ সালে ইস্পাত ব্যবসার শুরু। একটি জাহাজ কেনার মাধ্যমে যাত্রাটি শুরু হয় আমাদের। ইস্পাত খাতের ব্যবসায় প্রবেশ তখনই একটি ম্যানুয়াল রড কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে।

এরপর একে একে ব্যবসার প্রসার হতে থাকল। আমার বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান গড়ে তুললেন প্রয়াত দাদার নামানুসারে কবির গ্রুপ। স্থাপন করা হলো একের পর এক শিল্পকারখানা। শুরুতে ৫০-৬০ জন কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে আছেন ৫ হাজার মানুষ। সবার সহযোগিতাতেই আমাদের এগিয়ে চলা।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : পথ চলার মূলমন্ত্র কী?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : চলার পথের মূলমন্ত্র হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুশাসন মানা, কঠোর পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, সময়জ্ঞান ও সততা।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ‘শেকড় থেকে শিখরে’- এটি সম্পর্কে একটু বলবেন?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : ‘শেকড় থেকে শিখরে’ সেøাগানে কেএসআরএম এখন অন্যতম ইস্পাত প্রস্তুতকারী ব্র্যান্ড। ইস্পাত দিয়ে শুরু হলেও ক্রমান্বয়ে অন্যান্য খাতে, বিশেষ করে পণ্যবাহী জাহাজ ব্যবসায়ও এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। সাগরজুড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আমাদের এসআর শিপিংয়ের হাত ধরেই।

কেএসআরএম মূলত উন্নত কাঁচামালের ব্যবহার নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে। বুয়েটে পরীক্ষার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় গুণগত মানসম্পন্ন ভূমিকম্প সহনশীল রড। এ কারণে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে কেএসআরএম-এর আলাদা ব্র্যান্ড ইমেজ। যা আমাদের দীর্ঘ যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যবসার গতি-প্রকৃতিতে আপনাদের তৃতীয় প্রজন্মের ভূমিকা কেমন?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : ব্যবসা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। বর্তমানে কবির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ মোহাম্মদ শাহজাহান। বাবার পাশাপাশি আমরা দুই ভাই সারওয়ার জাহান রোকন ও শাহরিয়ার জাহান রাহাত পারিবারিক ব্যবসায় নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছি। তারও আগে থেকে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন আমাদের চার চাচা- নবাব সিরাজ উদ দৌলা, কামাল উদ্দিন, সেলিম উদ্দিন ও করিম উদ্দিন। আরেক চাচা জামাল উদ্দিন পেশায় চিকিৎসক। সবাই দায়িত্ব পালন করছি কবির গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। সুতরাং তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে আমরাও পারিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছি একাগ্রে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে একটু কি জানাবেন?

শাহরিয়ার জাহান রাহাত : সুদীর্ঘ সময়ের এই পথচলায় কেএসআরএম ইস্পাত শিল্পে অর্জন করেছে মানুষের আস্থা। দেশের গণ্ডি ছেড়ে দেশের বাইরেও যাবে এটি- এমন প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে কারখানার অবকাঠামো ও পরিবেশগত উন্নয়নসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করার পরিকল্পনাও আছে। পণ্যের উৎপাদনেও কিছু পরিবর্তন, নতুন পণ্য আনার পরিকল্পনা আছে।  রাউন্ড বার উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে স্ট্রাকচারাল স্টিলের বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও।

সর্বশেষ খবর