বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

যুদ্ধের প্রভাব খাদ্যপণ্যের বাজারে

ডলারের দাম উদ্বেগজনক

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

যুদ্ধের প্রভাব খাদ্যপণ্যের বাজারে

মাহবুবুল আলম, সভাপতি, চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ঢাকা- চট্টগ্রাম রোডের ওজন স্কেল। এই ওজন স্কেলের কারণে ১৩ টনের ওপরে চট্টগ্রাম থেকে কোনো পণ্য দেশের কোথাও নেওয়া যাচ্ছে না, অথচ সারা দেশের নিয়ম ভিন্ন। অন্য কোনো মহাসড়কে এই ওজন স্কেল নেই। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন কিংবা বাজার ব্যবস্থাপনায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রত্যেকটি পণ্যের কেজিতে ৩/৪ টাকা করে দর বাড়ছে।

চিটাগাং চেম্বার সভাপতি বলেন, অন্য মহাসড়কগুলোতে ২০/২২ টন ওজনের গাড়ি চলছে। সারা দেশে কোথাও এ নিয়ে আপত্তি নেই। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের ক্ষতি হবে- এমন আশঙ্কা থেকে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এই ওজন স্কেলকে ঘিরে সংকট জিইয়ে আছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৩৫টি মহাসড়ক রয়েছে। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেল বসানো হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চট্টগ্রামের ব্যবসা। এক কেজি ভোগ্যপণ্য চট্টগ্রামের বাইরের জেলায় নিতে কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি খরচ পড়ছে। শুধু ওজন স্কেল থাকায় চট্টগ্রামের বাইরের জেলায় ভোগ্যপণ্য পরিবহনের ট্রাকও পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও বেশি ভাড়া দিতে হয়। যা পণ্য মূল্যকে প্রভাবিত করছে। ওজন স্কেল ব্যবসার জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওজন স্কেলের বিষয়টি সড়ক ও জনপথ অধিদফতর দেখে। আমরা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।

নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চেম্বার সভাপতি বলেন, বিশ্বের অন্তত ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য আসে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। সেখানে যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়েছে। গেল এক বছরে বেড়েছে ডলারের মূল্যও। পণ্যের দামে আছে এসবের প্রভাবও।

মজুদ নীতিমালা বাস্তবতার আলোকে হালনাগাদ করার তাগাদা দেন চিটাগাং চেম্বার সভাপতি। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে চেম্বার সভাপতি বলেন, ‘সরকার আমদানি করা খাদ্যশস্য দ্রুত খালাসে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সে অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসও হচ্ছে। কিন্তু কোনো একটি আমদানির চালান নির্ধারিত সময়ের পর এলে আইপি (আমদানি আদেশ) সংশোধন করে আনতে হয়। তা না হলে সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে না প্রত্যয়নপত্র।

তিনি বলেন, ‘আবার আইপি সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করলেও নির্ধারিত সময়ে অনুমোদন মিলছে না বলেও অভিযোগ আছে। এরকম দৌরাত্ম্যের কারণে আমদানি করা খাদ্যশস্য বন্দরে এসে পৌঁছালেও ক্ষেত্রবিশেষে খালাস করতে ৫-৭ দিন দেরি হয়ে যায়। এতে আমদানিকারককে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, যার প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে।’

দেশের পুরনো, বনেদি ও প্রধানতম বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জের হারানো ঐতিহ্য সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুল আলম বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসার বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। পুরনো জৌলুস এখন আর নেই। এখন দেশের যে কোনো জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারেন। রাজশাহী-খুলনা-রংপুর-দিনাজপুর নোয়াপাড়া সব জায়গা থেকেই। এখন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ৭০০ জন ব্যবসায়ী ভারত থেকে মালামাল আমদানি করছেন। সীমান্ত আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। আগের মতো এককেন্দ্রিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেই।

খাতুনগঞ্জে আগের মতো ট্রেডার বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নেই। কেউ কেউ নামে আছেন, কাজে নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণ এখন আর খাতুনগঞ্জে নেই।

ব্যবসার বিকেন্দ্রীকরণ দেশের জন্য বা খাতুনগঞ্জের জন্য কী ইতিবাচক নয়?-এমন প্রশ্নের জবাবে চিটাগাং চেম্বার সভাপতি বলেন, ব্যবসার গতিপ্রকৃতি সম্প্রসারণ দেশের জন্য ভালো। তবে পুরনো প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে নেওয়া আইপি (ইম্পোর্ট পারমিট) সারা দেশের জন্য কার্যকর হচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্যই শুধু ব্যবহার হচ্ছে। সারা দেশের জন্য আইপি করতে হলে ঢাকায় ছুটতে হচ্ছে। বেনাপোল হয়ে ব্যবসা করতে চাইলে চট্টগ্রামের আইপি দিয়ে হবে না।  

কমার্শিয়াল ক্যাপিটাল হিসেবে চট্টগ্রামকে সারা দেশের জন্য আইপি করার ক্ষমতা দেওয়া উচিত। ব্যাংকগুলোর সদর দফতর না করলেও এডিশনাল এমডি পদ দিয়ে ক্ষমতায়ন করা দরকার। চট্টগ্রামকে অবহেলিত ও বঞ্চিত রাখলে তা সারা দেশের জন্যই ক্ষতি। বাণিজ্যিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ঢাকায় থাকলে হবে না। 

চট্টগ্রাম বন্দর সম্পদের সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে চেম্বার সভাপতি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের পূর্ণ ব্যবহার করা প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব বেটার্মিনাল করতে হবে। বন্দরে জেটির সংখ্যা বাড়িয়ে অন্তত ৬০ করা উচিত। বর্তমানে জেটির সংখ্যা ১৯টি বলে জানিয়ে মাহবুবুল আলম আরও বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই বেটার্মিনালের কাজ শেষ করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে হলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৮ লেনের করা উচিত। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বার্থেই চট্টগ্রামের সঙ্গে টেকসই সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। 

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে চিটাগাং চেম্বারের এই সভাপতি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, খাতুনগঞ্জে ব্যবসার ধরন পাল্টেছে। আগের ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) এখন সাপ্লাই অর্ডার (এসও) এ পরিণত হয়েছে। এখন এজেন্ট করে মালামাল সরবরাহ করা হয়। তা সত্ত্বেও কিছুটা অসংগতি আছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

তিনি বলেন, নিয়ম পরিবর্তন বা নতুন প্রক্রিয়ার পথে গেলেই হবে না, ব্যক্তি সততা একটি বড় বিষয়।

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগে ব্যবসায়ীরা সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন বলে দাবি এই ব্যবসায়ী নেতার। তিনি বলেন, গুটিকয়েক অসৎ ব্যবসায়ীর জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে দায়ী করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের প্রতি হয়রানিমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তা প্রকারান্তরে সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব পড়বে।

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চলতি ‘মধুমাস’ বিশেষ প্রভাব রাখবে বলে আশাবাদ এই ব্যবসায়ী নেতার।

তিনি বলেন, মৌসুমি ফলের সরবরাহ এই মধু মাসে ক্রমে বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক। মধু মাসে নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্তের অনেকেই মৌসুমি ফল খেয়ে দিনযাপন করেন। বস্তিবাসী বা তৃণমূলের অনেকেই আছেন কাঁঠাল খেয়েও দিন কাটান। আম-কাঁঠালের এই ভরা মৌসুমে অনেক নিত্যপণ্যের চাহিদা কমে যায়। ফলে দাম কমবে।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি তেলের দাম কমতে শুরু করার উদাহরণও টেনে আনেন।

চিটাগাং চেম্বার সভাপতি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৮ লেনের টেকসই মহাসড়ক হিসেবে নির্মাণ করা দরকার।  চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে পণ্য সরবরাহের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রামকে ঘিরে ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি, চট্টগ্রাম অভিমুখো পর্যটন সম্ভাবনা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের স্বার্থে চট্টগ্রামের সড়ক অবকাঠামো বন্দর ব্যবস্থাপনা  সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ঢেলে সাজানো দরকার।

সর্বশেষ খবর