বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশের বাইরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে নিটল-নিলয় গ্রুপ

আবদুল মাতলুব আহমাদ, চেয়ারম্যান, নিটল-নিলয় গ্রুপ

দেশের বাইরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে নিটল-নিলয় গ্রুপ

ছেলে নিলয়ের সঙ্গে আবদুল মাতলুব আহমাদ ছবি : জয়ীতা রায়

নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে যেসব শিল্প উদ্যোক্তা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের অন্যতম আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন পূরণ করেছেন। সফল হয়ে পথ দেখিয়েছেন সম্ভাবনার। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কিন্তু কেউ কেউ থাকেন যারা নিজের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যান। এমনই একজন দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপের কর্ণধার আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। লিখেছেন সাইফ ইমন-

 

হাসিখুশি ও ধৈর্যশীল মানুষ নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। নিজের সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আজ তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপতি। ৮০-এর দশকের শুরুতে গাড়ি বিক্রির ব্যবসা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপ। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতি মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘আমাদের নিটল-নিলয় গ্রুপ শুরু হয়েছিল নিটল মটরস থেকে। এর আগে আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস ছিল। ১৯৮১ আমরা বড় পরিসরে ব্যবসা শুরু করি। তখন আমরা ভাইয়েরা যে যার মতো আলাদা হয়ে যাই। সে সময় আমার একজন ছেলে ছিল নিটল। শুরুটা করেছিলাম নিটল মটরস দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল কমার্শিয়াল ভেহিকেলকে বাংলাদেশে প্রসার ঘটানো। তখন বাংলাদেশে একটা গাড়ি কিনতে গেলে ছয় মাস দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আরও প্রতিবন্ধকতা ছিল। আমি চিন্তা করি প্রথমে এই পরিস্থিতি বদলানো দরকার। মানুষ কেন গাড়ির জন্য বসে থাকবে। হওয়া উচিত গাড়ি মানুষের জন্য বসবে। গাড়ি স্টক ইয়ার্ডে থাকবে শোরুমে থাকবে মানুষ আসবে গাড়ি কিনবে। তখন দেখা যেত, ছয় মাস ধরে বসে আছে কেউ। যখন গাড়ি এলো দেখা গেল অন্য একজন বেশি টাকা দিয়ে নিয়ে নিল গাড়িটি। এই যে একটা পরিস্থিতি। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছিলাম। কমার্শিয়াল গাড়ির জন্য কোনো ব্যাংক টাকা দিত না। ওরা তখন বলত, এটা বাজে সেক্টর এখানে টাকা দিলে টাকা আসে না। মানুষ যে কমার্শিয়াল গাড়ি কিনে আয় থেকে দায় শোধ করতে পারে, গাড়ির মালিক হতে পারে এটা আমার আরও একটা ভিশন ছিল।’

বছরে অন্তত ৫০০ থেকে ৭০০ নতুন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয় নিটল-নিলয় গ্রুপে। এর মধ্যে তরুণদের মেধা ও ইনোভেশনকে কাজে লাগাতে এন্ট্রি লেভেলে বেশির ভাগই ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় আবদুল মাতলুব আহমাদ মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। নিজের ব্যবসা শুরুতে তিনি হিন্দুস্থান মটরস-এর ডিলারশিপ দিয়ে শুরু করেন।

তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে হিন্দুস্থান মটরস অন্যদের সঙ্গে চুক্তি করার পর আমি মিটশুবিসির সঙ্গে ব্যবসা শুরু করলাম। তাদের ডিলারশিপ নিলাম। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের দিকে টাটা মটরস এলো। তারা বলল যে, তাদের ডিলারশিপ এবং ডিস্ট্রিবিউশনটা আমাকে দিবে। সে সময় রতন টাটাও নতুন ঢুকেছেন। আমিও তখন বললাম যে, বাংলাদেশে অ্যাসেম্বলি কেউ করতে দিচ্ছে না। তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও তাহলে আমি সরকারের সঙ্গে বসব। আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব। আরও বলি যে, তোমার ডিস্ট্রিবিউশনটা আমি তখনই নিব যখন আমি এর সঙ্গে অ্যাসেমব্লিং  করে ইন্ডাস্ট্রি করতে পারব। সে সময় ভারতেও ফরেন কারেন্সির ইনভেস্টমেন্ট হতো না। আজকের মতো পরিস্থিতি ছিল না। রতন টাটা আমার সঙ্গে একমত হলেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম যে ফ্যাক্টরিটা হলো নাম হলো নিটা।’

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদানের জন্য সিআইপি কার্ড পেয়েছেন আবদুল মাতলুব আহমাদ ও তাঁর স্ত্রী এমপি সেলিমা আহমাদ। নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সেলিমা আহমাদ। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকে দেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপ।

মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘আমরা ১৯৯১ সালে প্রথম প্রোডাকশন শুরু করি। এভাবেই আমাদের বিশেষ অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর আমরা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইটেমে ঢুকে গেলাম। যেমন- নানা প্রকার সিমেন্ট, আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ারস ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করলাম। আর ১৯৮৬ সালে ছোট ছেলে নিলয় হলো। তারপরে আমি গ্রুপটাকে নামকরণ করি নিটল-নিলয় গ্রুপ। আর মহাখালীতে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের নাম হলো নিটল-নিলয় সেন্টার। নিটল-নিলয় দুই ছেলেই আমাদের সব প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছে। ব্যবসা পরিচালনায় আমার সঙ্গে রয়েছে। আর শেষ ১০ বছর থেকে আমার নাতিরা চলে এসেছে। বর্তমানে ওদের নামে অনেক কোম্পানি হচ্ছে। পুরো গ্রুপটাই ফ্যামিলি গ্রুপ এখন।’

শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা মাতলুব আহমাদ আরও বলেন, ‘দেশ যেভাবে ওপরের দিকে গেছে আমরাও দেশের সঙ্গে সঙ্গে ওপরের দিকে এসেছি। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে চেষ্টা করেছি। আজ ও আগামীতে বৈদ্যুতিক গাড়ি,  বৈদ্যুতিক কমার্শিয়াল গাড়ি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছি। ভবিষ্যতে আমাদের বৈদ্যুতিক থ্রি হুইলার, টু হুইলার ও কমার্শিয়াল ট্রান্সপোর্ট চলে আসবে। এ ছাড়াও আমাদের পেপার মিল খুব ভালো চলছে। আমাদের নিটল-নিলয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ছাতকে অবস্থিত। সেখানে ৪০০ বিঘা জায়গার ওপর নানা পরিকল্পনাও রয়েছে। সেখানে গ্রিন ব্রিকস হবে, নানা প্রকার ফুড আইটেম হবে। কিশোরগঞ্জে রয়েছে স্পেশাল ইকোনমি জোন। সুগারমিল ছিল। ওইখানে টায়ার প্ল্যান্ট ছাড়াও অনেকেই ইনভেস্টমেন্ট করতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশের যশোরে আমাদের অনেকগুলো ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। অনেকগুলো প্লান্ট আছে। রিজিয়নাল হেডকোয়ার্টার আমরা তৈরি করছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকবে আমাদের রিজিয়নাল হেডকোয়ার্টার যেমন রংপুর, বগুড়া, সিলেট, কক্সবাজার, চিটাগং। যশোরে ইতোমধ্যে রিজিয়নাল হেডকোয়ার্টার হয়ে গেছে। আমি মনে করি নিটল এবং নিলয় সফলভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবে। নিটল অনেক দিন হয়ে গেল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছে। আমাদের ব্যবসার একটা অংশ নিটল নিজে পরিচালনা করছে। আর নিলয় ইতোমধ্যে আমাদের ম্যানেজমেন্টে ভালোভাবেই যুক্ত হয়েছে। টাটা মটরস থেকে লিডারশিপ ট্রেনিং প্রোগ্রামের মধ্যে এক বছর থাকবে। পরবর্তীতে আমাদের গ্রুপে নেতৃত্ব পর্যায়ে কাজ করবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানকে আমরা ন্যাশনাল পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান করব। সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করব। আমি মনে করি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। অবদান রাখতে পারবে আমাদের অর্থনীতিতে।’ দেশের বাইরে কী বিষয়ে কাজ করতে চান এমন এক প্রশ্নের জবাবে মাতলুব আহমেদ বলেন, ‘আমি চেয়েচিলাম কৃষিভিত্তিক কিছু করতে আফ্রিকায়। সেটাতে তখন সবার অনুমতি পাওয়া গেল না। আগামীতে আমরা ভোজ্যতেল নিয়ে কাজ করতে পারি। প্রথমে আমরা বাংলাদেশে সরিষা নিয়ে কাজ করব। সরিষার পরে আমরা সরিষার তেল নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেছি। এই ব্যবসা বৃদ্ধিতে আমরা পৃথিবীর নানা দেশে যাব। ভালো বীজ উন্নয়নেও কাজ করব।’

পরিবার থেকে ব্যবসায় এসেছেন মাতলুব আহমাদের ছোট ছেলে নিলয়। এ প্রসঙ্গে নিলয় বলেন, পরিবার থেকে ব্যবসায় এসেছি কিন্তু কোনো পার্থক্য নেই। ছোটবেলা থেকেই ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে বড় হওয়া। দেখা গেছে, আমরা যখন পারিবারিক কোনো ভ্রমণে যাই দেখা যায় চেয়ারম্যান স্যারের কাজের সঙ্গে মিলিয়েই যাওয়া হয়। আমরা আসলে সারাক্ষণ ব্যবসায়িক পরিমন্ডলেই রয়েছি। পরিবার এবং ব্যবসা একই সূত্রে গাঁথা। আর আমার ভালোই লাগে। এটা আমরা সব সময় দেখে আসছি। ফলে বিষয়টা আমার কাছে অনেক সাধারণ মনে হয়। ছোটবেলায় দেখা গেছে, আমি মিটিংয়ের মধ্যে চলে আসতাম। তাই আমার কাছে ব্যবসায় আসা নতুন কিছু নয়। তবে আমার কাছে মনে হয়, দায়িত্বটা অনেক বেড়ে গেছে এখন। চেষ্টা করছি পারিবারিক লিগেসি সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

সর্বশেষ খবর