বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বৈশ্বিক পণ্য হয়ে উঠবে

অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু - পরিচালক, স্কয়ার গ্রুপ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন ও সাইফ ইমন

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বৈশ্বিক পণ্য হয়ে উঠবে

ছবি : জয়ীতা রায়

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করেই ফিরে আসেন দেশে। পারিবারিক ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে দুই দশকের বেশি সময় ধরে পিতা স্যামসন এইচ চৌধুরীর হাতে গড়া স্কয়ার গ্রুপের বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগের পাশাপাশি সংস্কৃতি-শিক্ষা-ক্রীড়া সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকম এ বছর পদার্পণ করেছে ২৫ বছরে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এসব বিষয়ে নিজের কথা তুলে ধরেছেন...

 

শুরুটা যেভাবে হয়েছিল

১৯৫৮ সালে চার বন্ধু মিলে শুরু করেছিলেন আমার বাবা। সে সময় বাবা আমার দাদার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা ছোট পরিসরে শুরু করেন। অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। এখন আমরা এ পর্যায়ে রয়েছি। আমার মায়েরও অনেক অবদান রয়েছে। আমার বাবা অসাধারণ একটা সাপোর্ট আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। বর্তমানে আমার মা দেশের দীর্ঘমেয়াদি করদাতাদের মধ্যে অন্যতম। তখন আমার বয়স মাত্র চার বছর। আমার বাবা চেয়েছিলেন নিজে একটা কিছু করার। বাবার দুই বন্ধু ছিলেন ডাক্তার আর একজন ছিলেন ব্যবসায়ী। এই চারজন মিলে শুরু করেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। দেশের ওষুধ শিল্পে আমরা এক নম্বরে অবস্থান করছি প্রায় ৪০ বছর ধরে। এরপর শুরু হয় স্কয়ার টেক্সটাইল। সে সময় অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ওষুধ শিল্প থেকে কেন টেক্সটাইল শিল্পে বিনিয়োগে যাচ্ছি আমরা। আমি গর্ববোধ করে বলতে পারি, দেশের অনেকে শেয়ার মার্কেট থেকে টাকা তুলে তারপর ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। কিন্তু আমাদের বেলায় উল্টো হয়েছে। আমার বাবা বলেছিলেন তিনি অন্যের টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে চান না। কারণ যদি লোকসান হয় তাহলে শেয়ারধারীদের লোকসানের বোঝা বহন করতে হবে।  শেয়ারধারীরা তাদের জামানত বিশ্বাস করে দিয়েছেন। আমরা  চেয়েছি শুরু থেকেই যেন তারা লাভের মধ্যে থাকেন। যখন আমরা শেয়ার মার্কেট থেকে টাকা তুললাম তখন কিন্তু তার বিপরীতে টেক্সটাইলের লভ্যাংশও তাদের দেওয়া হলো। যেটা শেয়ারধারীরা আশা করেনি। এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কনসেপ্ট। আমার বাবার চিন্তাধারাই ছিল সবার চেয়ে আলাদা। সেটা নিয়েই গর্বের সঙ্গে কাজ করছি। উনি বিশ্বাস করতেন সফল হতে হলে কোনো শর্টকার্ট নেই। কষ্ট করে মেধা মননের সমন্বয়ে সফলতা অর্জন করতে হয়। টিমের প্রতি আস্থা থাকতে হবে। এই আস্থাটা তৈরি হবে উদ্যোক্তা ও কর্মীদের বন্ধনের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের সবাইকে এক পরিবার ভাবতে হবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে- ‘হ্যাপি ফ্যামিলি ইজ প্রোডাকটিভ ফ্যামিলি’। আমরা কিন্তু সহকর্মী বলি না। আমরা বলি পরিবার। আমরা এখন পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। সেই ১৯৫৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো স্ট্রাইক বা আন্দোলন এমন কিছু ঘটেনি আমাদের প্রতিষ্ঠানে।

 

করোনাকালে

করোনাকালে মানুষজন অসহায় হয়ে পড়লেন। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ, উৎপাদনও বন্ধ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ফ্যাক্টরিতে গিয়ে তাদের বলেছি, তোমরা বাসায় থাকলেও বেতন ঠিকই চলে যাবে। কাজ বন্ধ থাকলেও স্কয়ার গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের কারও বেতন নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। ফ্যাক্টরিতে কাজ না থাকার পরেও বেতন বন্ধ হয়নি। সবাই ঠিকমতো বেতন পেয়েছেন। স্কয়ার এভাবেই সব সময় কর্মী পরিবারের পাশে থাকে।

 

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে

আমার তখন ১৭ বছর বয়স। দেশের টানে জাতির পিতার ডাকে আমরা গিয়েছি। আমি বিএলএফ ছিলাম। মুজিব বাহিনী। আমরা সাড়ে ১৩ হাজার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এটা মনে করি বিরল সুযোগ যে ঠিক সময় মতো জন্মেছিলাম। দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় অর্জন করা সবার জীবনে আসে না। আমাদের প্রশিক্ষণ হয়েছিল ৬ হাজার ফুট পাহাড়ের ওপরে। সেটা একটা ভিন্ন জীবন ছিল আমাদের। তখন কিন্তু কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হয়নি।

 

ব্যবসায় আমি

যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করেই আমি দেশে ফিরে আসি। বাবাকে বলি, আমি ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে চাই। তিনিও উৎসাহ দিলেন। আমি যখন দেশে আসি আমাদের স্কয়ার টয়লেট্রিস লিমিটেডের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তখন জুঁই তেল দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। নামকরণ হয়েছিল আমাদের বাড়ির বড় মেয়ের নামে। জুঁই আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে। এরপর মেরিল শ্যাম্পু এলো।

গোড়াতেই আমার কাজ হলো, মেরিল নামটি যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা। ওই সময় মাসের বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাইরে থেকেছি। দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে যাইনি। সেখানে বিভিন্ন মার্কেটে আর দোকানগুলোতে যেতাম। এখন একজন বিক্রয় প্রতিনিধি যেভাবে সবার কাছে যান, তখন আমিও তেমনিভাবে গিয়েছি। যেহেতু পণ্যের নামগুলো পরিচিত ছিল না, দোকানদাররা প্রথমে পণ্য নিতে চাইতেন না। তারা বাকি চাইতেন। আমি সবাইকে বলেছি, আমাদের বাকির কোনো ব্যাপার নেই। আপনি প্রয়োজনে অল্প পণ্য নেন, নগদে নিতে হবে। শুনে কেউ কেউ বলেছেন, তাদের কথা বলার সময় নেই। আমি কিন্তু চলে আসিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ক্রেতাদের ভিড় কমলে কিছুক্ষণ পর সেই দোকানিই আবার ডেকে নেন। বলেন, ভাই আপনি ঠিকই বলেছেন, বাকিতে ব্যবসায়িক সম্পর্ক নষ্ট হয়। আমরা নগদেই আপনার পণ্য নেব। এই যে সারা দেশে ঘুরেছি, দোকানে দোকানে গিয়েছি-  এটা আমার জন্য একটা শিক্ষা। তা হলো, ধৈর্য থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।

 

টয়লেট্রিজ থেকে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ

স্কয়ারের টয়লেট্রিজ পণ্য নিয়ে সারা দেশে ঘুরতে ঘুরতে একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়ে। তখন খোলাবাজারে প্রচুর ভেজাল মসলা পাওয়া যেত। আমাদের বাড়ি ছিল মফস্বল শহরে। এর একটা বাড়তি সুবিধা হলো, সেখানে খাঁটি জিনিসটা আমাদের হাতের নাগালে। সেই ভাবনা থেকে মনে হলো, আমরা তো ভালো মানের মসলা বাজারে দিতে পারি। আমি আমার ইচ্ছার কথা আমাদের চেয়ারম্যান অর্থাৎ বাবাকে বললাম। বাবার একটা বিষয় ছিল তিনি কখনো কোনো আইডিয়াকে না করতেন না। উৎসাহ দিয়েছেন। এভাবে স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গেই স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড শুরু করি। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শুরু হয়েছিল স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড থেকে।

 

যেভাবে মিডিয়ায়

সে সময় আমাদের পণ্যের পরিচিতির জন্য প্রচুর বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন ছিল। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের জন্য আমরা কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতাম। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না তাদের কাজে। এমন ছিল যে, অগ্রিম টাকা নিয়ে কাজটা সঠিক সময়ে দিত না। এসব আমার পছন্দ ছিল না। আমি তখন নিজের প্রতিষ্ঠান থেকেই বিজ্ঞাপন তৈরির কথা ভাবলাম, আর এভাবেই শুরু মিডিয়াকমের। এ বছর মিডিয়াকমের ২৫ বছর পূর্তি। মিডিয়াকম থেকেই মাছরাঙা টেলিভিশনের শুরু। তবে এখানেই থেমে থাকিনি আমি। যেহেতু মনের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি দরদ ছিল, সে কারণে পরিচ্ছন্ন নাটক ও চলচ্চিত্রে যুক্ত হলাম। এ পর্যন্ত লালসালু, শঙ্খনাদ, আয়না, লালন, মনপুরা ছবিগুলো প্রযোজনা করেছি। মনপুরার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এভাবে মিডিয়ায় কাজের শুরু আমাদের।

 

বাবা স্যামসন এইচ চৌধুরী প্রসঙ্গে

বাবা ছিলেন আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বাবা খুব নিয়ম মেনে চলেন। তাঁর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, সরলতা; সব কিছুই ছিল অনুকরণীয়। সময়ের কাজ তিনি সময়ে করতেন। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি। প্রতিবছর বাবা শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতেন। নিয়ম মেনে নয়, এটাই ঐতিহ্য। প্রত্যাশার চেয়ে তিনি বেশি দিয়ে এসেছেন সব সময়। তিনি তাদের সঙ্গে যেভাবে আলোচনা করতেন, মনে হতো যেন নিজের পরিবারের মধ্যে বসে আলোচনা করছেন। বাবার কাছ থেকে এভাবেই শিক্ষা পেয়েছি।

 

সামাজিক দায়বদ্ধতা

শিল্প-উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের প্রচুর সামাজিক কার্যক্রম রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি। সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন, ড্রাইভার সবার সন্তান সমান সুবিধা নিয়ে লেখাপড়া করে। কোনো ধরনের বৈষম্য সেখানে নেই। পরিবেশ রক্ষায় আমরা এখন  কেমিক্যালনির্ভর পণ্য থেকে ভেষজ পণ্যের ওপর জোর দিচ্ছি। বৃক্ষরোপণ, বনায়নের জন্য বিভিন্ন সময় আমরা গাছের চারা উপহার দিচ্ছি। সাভারে একটা এতিমখানা রয়েছে, যেটি আমার মা দেখাশোনা করছেন। সামাজিক কার্যক্রমে আমাদের পারিবারিক সম্পৃক্ততা আমাদের পিতার দেখানো পথেই এগিয়ে চলছে।

 

ভবিষ্যৎ নিয়ে

দেশে শিল্পে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগব্যবস্থার নতুন দিক উন্মোচিত হবে। কানেকটিভিটি এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম সুযোগ। এই সুযোগ নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে এজন্য দরকার সরকারের নীতিসহায়তা। তাহলেই দেশের বেসরকারি খাত উজ্জীবিত হবে। ভোক্তা-কর্মী সবার ভালোবাসা নিয়ে স্কয়ারের পণ্য দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও জায়গা করে নিয়েছে। কেনিয়ায় আমরা স্কয়ার ফার্মার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা কিন্তু সরকারের অনুমতি নিয়েই বিদেশে স্কয়ারের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেছি। সঠিক নীতিসহায়তা পেলে এভাবেই একদিন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বৈশ্বিক পণ্য হয়ে উঠবে।

সর্বশেষ খবর