বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পোলট্রি খাতের লাভ-লোকসান

আমিষের বড় ভরসা ডিম ও মুরগির মাংস

মানিক মুনতাসির

পোলট্রি খাতের লাভ-লোকসান

করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন সংকটে পড়েছে দেশের পোলট্রি খাত। একদিকে পোলট্রি শিল্পের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অন্যদিকে দেশজুড়ে লোডশেডিং বাড়ায় হ্যাচারি ও ফার্মগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। ফলে সারা দেশে গড়ে ওঠা ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ মুরগির খামার এখন অস্বিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। এ খাতে অন্তত ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তবে বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করায় তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা বলে তাদের অভিযোগ। এদিকে গত মাসের শুরুতে সারা দেশে ডিমের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে কিছুটা কমে এলেও ব্রয়লার মুরগির দাম এখনো চড়া। গরিরবের আমিষ খ্যাত ব্রয়লার মুরগি ও ডিম কিনতে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উদ্যোক্তারা জানান, এ খাতে অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।  সম্প্রতি বিদ্যুৎ সংকটের কারণে হ্যাচারিগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে জেনারেটর চালিয়ে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। জেনারেটরের জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে ব্রয়লার মুরগির প্রতি কেজি মাংসের উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে এক মাসের ব্যবধানে।  বেড়েছে ডিমের উৎপাদন খরচও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতি পিস ডিম উৎপাদনে এখনো ৯ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ছে বলে খামারিরা জানিয়েছেন। এজন্য সরকারি সহায়তার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ খাত-সংশ্লিষ্টরা। তবে ভোক্তারা বলছেন, পোলট্রি খামারিরা বরাবরই লোকসানের দোহাই দিয়ে আসছেন। তারা সব সময় সরকারের কাছে কান্নাকাটি করেন সহায়তার জন্য। এতই যদি লোকসান হয় তাহলে তারা এ ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় যান না কেন। ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, কখনো কখনো ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টাও লোডশেডিং হচ্ছে। মুরগির বাচ্চা যদি সঠিক সময়ে সঠিক তাপমাত্রা না পায়, তাহলে বৃদ্ধিজনিত সমস্যা হয়। এতে বাচ্চা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন নানা রোগও দেখা দেয়। এমনকি বাঁচানোও যায় না। শুধু ডিজেলের খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি পিস ডিমের উৎপাদন ব্যয় ২৫ থেকে ৫০ পয়সা এবং একটি বাচ্চার খরচ ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে গেছে। মূলত উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণেই মুরগির দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানান তিনি। ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে মুরগির খামারগুলোতে প্রতি মাসে সোয়া ৫ লাখ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টন পোলট্রি খাবারের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার শতভাগই আসে দেশি ফিডমিল থেকে। তবে কাঁচামালের বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। গেল এক বছরে প্রাণিজ খাবারের উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। চাপ রয়েছে ডলারের দাম বাড়ায়ও। তারপরও বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের দাম। এ অবস্থায় শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এ খাতের এসএমই উদ্যোক্তা ভাই-বোন পোলট্রি ডেইরি ফিসারিজের স্বত্বাধিকারী শিরীন সুলতানা জানান, পোলট্রি ফিডের দাম কমানো হলে ডিমের দাম অটোমেটিক কমবে। দেশের বেশির ভাগ খামার বন্ধ হচ্ছে পোলট্রি ফিডের উচ্চ মূল্যের কারণে। এতে করে একদিকে যেমন বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাবে অন্যদিকে আমরা বঞ্চিত হব আমাদের প্রাণিজ আমিষ প্রোটিন থেকে। সরকারের উচিত অন্যান্য জিনিসের মতো ডিমের দাম নির্বারণ করে দেওয়া। পোলট্রি ফিডের দাম কমানো। তিনি আরও বলেন, মানুষ একটা বেনসন সিগারেট কেনে ১৮ টাকা দিয়ে অথচ একটা ডিম ১০ টাকা দিয়ে কিনতে কষ্ট হয়। কিন্তু একটা ডিমের পেছনে খরচই পড়ে প্রায় ১০ টাকা। তারপরও সরকার চাইলে খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে ডিম এবং মুরগি উভয়েরই দাম কমাতে পারে। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সারা দেশে ২৩৩৫.৩৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে এই উৎপাদন তিন গুণের বেশি বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ে পোলট্রি সেক্টরে দিনে ৪ কোটি পিসের বেশি ডিম উৎপাদন হয়েছে; যা দেশের চাহিদার পুরোটাই অভ্যন্তরীণভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া ডিম সব শ্রেণির মানুষ ব্যবহার করলেও ব্রয়লার মুরগির চাহিদা রেস্টুরেন্ট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে প্রতিদিনই বাড়ছে। এদিকে করোনার আগে খামার পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংস উৎপাদনে খরচ হতো ৯০ থেকে ১০০ টাকা। সম্প্রতি এটি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ফলে মুরগির মাংস ও ডিমের দামও বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৩৯.২৯ শতাংশ এবং ডিমের দাম হালিতে ২৮.৫ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ডেইরি, মৎস্য ও পোলট্রি খাতে প্রায় একই রকম খাবার ব্যবহার হয়। প্রাণিজ খাদ্যের আকাশচুম্বী দামের কারণে ভোক্তারা অস্বস্তিতে ভুগছেন। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে তিনটি কাজ করতে পারলেই পণ্যের দাম ২০-২২ শতাংশ কমে যাবে।  প্রাণিজ খাবারের অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিল রপ্তানি বন্ধ, এ খাতে ব্যবহৃত সব পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং মাংস ও হাড়ের তৈরি প্রোটিনসমৃদ্ধ প্রাণিজ খাবার (মিট বোন মিল) আমদানি শুরু করতে হবে।

সর্বশেষ খবর