বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আরও তীব্র হতে পারে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট

দেশে দেশে উৎপাদন কমেছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবও ভোগাচ্ছে বিশ্বকে

মানিক মুনতাসির

আরও তীব্র হতে পারে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট

করোনা মহামারির পর নানামুখী সংকট পার করছে বিশ্ব। অনেক দিন ধরেই জ্বালানি সংকটের কারণে দেশে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম গত প্রায় নয় মাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। যদিও এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে তেমন একটা পড়েনি। দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে অস্বস্তিতে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। বিশেষ করে নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। অথচ আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রায় কঠিন এক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এ শ্রেণির মানুষ।

 

এদিকে জাতিসংঘের খাদ্যসহায়তা-সংক্রান্ত শাখা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি জানিয়েছে- করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০১৯ সালের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। ডব্লিউএফপির আঞ্চলিক পরিচালক করিন ফ্লেশার বলেন, করোনা মহামারি শুরুর আগে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি। এরপর এ সংখ্যা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘর্ষের ফলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশগত সমস্যার প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা খাদ্যঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া জলবায়ু-সংকটের ফলে আরও সংঘাত ও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, এই মুুহূর্তে বিশ্বজুড়ে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু ডব্লিউএফপির পক্ষে কেবল ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে তারা যে সহায়তা দেয়, তাতে একজন মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার অর্ধেক পূরণ করা সম্ভব। এর পেছনে তহবিলের স্বল্পতার কথা বলেছে জাতিসংঘের এই সংস্থাটি। এ সংকট আরও তীব্র হতে পারে সামনের দিনগুলোতে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যতটা প্রলম্বিত হবে এ সংকট ততটাই বাড়ার আশঙ্কা রযেছে।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন মূলত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে খাদ্য শৃঙ্খলে। বিশ্বের অন্তত ২৩টি দেশ নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ঠিক রাখতে কমপক্ষে ৩৩ ধরনের খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার ফলে বিশ্বের অনেক দেশই খাদ্য সংকটের আতঙ্কে রয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশে খাদ্য ব্যবস্থা অর্ধেক কিংবা তার কম আমদানিনির্ভর সেসব দেশ সংকটময় পরিস্থিতি পার করছে। এদিকে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে অব্যাহতভাবে।

গত ১৮ আগস্ট প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। খাদ্য নিরাপত্তা ও ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বের নানা দেশের নানা সমস্যা সংবলিত তথ্যাদি উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। এ ছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদনেও বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

এদিকে বিশ্বজুড়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এর সঙ্গে একমত হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বলেছে, বৈশ্বিকভাবে যে হারে আমদানি পণ্য ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে তাতে মূল্যস্ফীতির ঘোড়াকে সামলে রাখা কঠিন হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশে উঠেছে। এ ছাড়া চীন, ভারত, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, কানাডাসহ বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোতে অতিরিক্ত বন্যা, খরা কিংবা দাবানলে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ফলে উৎপাদন কমেছে। আগামী মৌসুমেও উৎপাদন কম হবে ব্যাপক হারে। এ জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব বিশ্বনেতাদের সতর্ক করেছেন খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে। এ অবস্থায় নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে মজুদ বাড়াচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য কৃষি খাতের ভর্তুকি কমানোর আইএমএফের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খাত মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় গড় মূল্যস্ফীতি বছর শেষে সাড়ে ১৫ শতাংশে দাঁড়াবে। যা এ অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলতে পারে। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন ও মজুদে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও এ খাতের মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে দাম বাড়লেও দেশে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা নেই বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি জানান, সরকারি গুদামে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমন উৎপাদন ভালো হয়েছে বলে জেলা প্রশাসকরা তথ্য দিয়েছেন। তবুও পাঁচটি দেশ রাশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এর ফলে চালের দাম কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা কমেছে।  খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আরও অন্তত তিন মাস পর্যন্ত পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত  হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর