দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে আছে একটি সাপ। সরীসৃপটির শীতল স্পর্শ যেন এক মুহূর্তের জন্য শান্তি দেয়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই ফিরে আসে যুদ্ধের ভয়াবহ শব্দ, বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি। আতঙ্কে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। গাজা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরার ১৮ মাস পরও মুক্তি নেই সেই স্মৃতি থেকে। হামাসের হামলায় আহত ২৭ বছর বয়সী এক সাবেক সার্জেন্ট মেজর এখন ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলের এক খামারে প্রাণীর সংস্পর্শে থেরাপি নিচ্ছেন, যুদ্ধের ট্রমা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে।
এই সেনা জানান, তাঁর দুই সহযোদ্ধা আত্মহত্যা করেছেন। দুজনের বয়সই কুড়ির ঘরে। তিনি বলেন, “এখন পাশ দিয়ে যদি কোনো বিমান বা ড্রোন উড়ে যায়, কিংবা কেউ চিৎকার করে, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ আমি এখন এই সাপের সঙ্গে আছি।” মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি।
গাজা যুদ্ধের দীর্ঘ লড়াই এখনো অনেক ইসরায়েলি সেনার মনে ভয়াবহ ছাপ ফেলে গেছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরা হাজারো সেনা আজ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বাড়ছে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি), বিষণ্নতা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা। অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে প্রায় ১১ হাজার সেনা মানসিক আঘাতজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এই সংখ্যা ইসরায়েলের ৮০ বছরের সামরিক ইতিহাসে যুদ্ধে মানসিক আঘাতে আক্রান্ত মোট সৈন্যের এক–তৃতীয়াংশেরও বেশি।
মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুদ্ধের আগে এক দশক ধরে প্রতি বছর গড়ে ১৩ জন সেনা আত্মহত্যা করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সেই সংখ্যা বেড়ে গেছে—গত বছর আত্মহত্যা করেছেন ২১ জন সেনা। এই হিসেবে দায়িত্বরত সদস্যদের পাশাপাশি রিজার্ভ সেনারাও অন্তর্ভুক্ত। তবে অবসরের পর যারা আত্মহত্যা করেছেন, তারা এই পরিসংখ্যানে নেই।
ইসরায়েলি পার্লামেন্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত আরও ২৭৯ জন সেনা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, যদিও তাঁরা বেঁচে গেছেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগের উপমহাপরিচালক লিমোর লুরিয়া বলেন, “মানসিক আঘাতের প্রভাব এখন সবাই উপলব্ধি করছে। এর চিকিৎসা প্রয়োজন এবং তা সম্ভবও।” তাঁর ভাষায়, “আগের যুদ্ধের আহত সেনারা অনেক সময় সাহায্য নেননি, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা।”
এই সংকট মোকাবিলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শত শত মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পাঠানো হচ্ছে, চালু হয়েছে হটলাইন ও থেরাপি সেশন। তবু বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা—ইসরায়েল এখনো এত বড় মানসিক স্বাস্থ্য সংকট সামলানোর মতো প্রস্তুত নয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগও একে স্বীকার করেছে। তাদের মতে, এই সংকট পুরো জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করছে।
ট্রমা থেরাপি বিশেষজ্ঞ টুলি ফ্লিন্ট বলেন, “দীর্ঘ যুদ্ধ ও বারবার মোতায়েন সেনাদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। এতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে পুনরুদ্ধারের সুযোগ পাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এটি দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি সময়মতো চিকিৎসা না দেওয়া হয়, যুদ্ধের মানসিক ভুক্তভোগীরা নিজেদের, পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারেন।”
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে কথা বলা কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী জানান, অনেক সেনা যুদ্ধ শেষে জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলছেন। সম্পর্ক গড়া, মনোযোগ ধরে রাখা, এমনকি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করাও তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসহায়ত্ব ও হতাশার অনুভূতি আরও গভীর হচ্ছে।
২৭ বছর বয়সী এক সাবেক রেডিও টেকনিশিয়ান জানান, “গাজার সীমান্তে আমার ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এরপর থেকে আমি আতঙ্কে থাকতাম, সামান্য শব্দেও ভয়ে কেঁপে উঠতাম। মনে হতো কেউ আমার রাগ, চিৎকার ও অনুভূতির ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছে।”
এই সেনা এখন ‘ব্যাক টু লাইফ’ নামের এক খামারে থেরাপি নিচ্ছেন। খামারটি স্থাপন করেছিলেন আসি নাভে, তাঁর বন্ধু আমির ইয়ারদিনাই (দানি)–এর স্মরণে, যিনি ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধ শেষে দীর্ঘ পিটিএসডিতে ভুগে আত্মহত্যা করেন। এই খামারে আহত সেনারা প্রাণীদের যত্ন নিয়ে ও প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করেন।
পরামর্শদাতা মনোবিজ্ঞানী গাই ফ্লুম্যান বলেন, “সেনাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নাগরিক জীবনে মানিয়ে নেওয়া। প্রাণীদের সঙ্গে থাকা তাঁদের মনকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে।”
৩১ বছর বয়সী এক সাবেক সেনা বলেন, “মনে হতো আমি এখনো যুদ্ধক্ষেত্রেই আছি। আমার শরীর এখানে, কিন্তু মন ওখানে।”
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক লিমোর লুরিয়া জানান, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এখনো সামাজিক কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত। এই কলঙ্ক দূর করতে সচেতনতামূলক প্রচারণা, পুনর্বাসন খামার ও অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের মতো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
৩২ বছর বয়সী এক রিজার্ভ সেনা, যিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে নিহতদের মরদেহ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন, বলেন, “আমি যেন সবসময় মৃতদেহের গন্ধ পাই—এমনকি সন্তানের ডায়াপার বদলানোর সময়ও।” তিনি নিজেই একজন থেরাপিস্ট; তাই দ্রুত বুঝতে পারেন এটি পিটিএসডির লক্ষণ। এখন তিনিও অন্য সৈন্যদের সহায়তা করছেন।
তিনি বলেন, “যখন কোনো কমান্ডার নিজেই বলেন, ‘তুমি সাহায্য নিতে পারো’, তখন বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যায়। এতে ভয় বা সামাজিক কলঙ্ক কমে যায়।”
সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, টাইমস অব ইসরায়েল
বিডি প্রতিদিন/আশিক