বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুলিশ-সিবিআই অচলাবস্থা কাটাল

তিনদিন পর ধরনা তুললেন মমতা ♦ পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার না করার নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

কলকাতা প্রতিনিধি

পুলিশ-সিবিআই অচলাবস্থা কাটাল

ধরনায় অংশ নেয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা

কলকাতা পুলিশ ও সিবিআই দ্বৈরথের অচলাবস্থা কাটালেন সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেন, চিটফান্ডের তদন্তে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে সিবিআইয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। তাকে সিবিআইয়ের জেরার মুখোমুখি হতে হবে। তবে সিবিআই রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করতে পারবে না। রাজীব কুমারকে সিবিআই জেরা করবে ঠিকই, তবে তা কলকাতা বা দিল্লিতে নয়। জেরা হবে কোনো নিরপেক্ষ স্থানে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে সেই জেরা হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় কলকাতার ধর্মতলা চত্বরে মেট্রো চ্যানেলের ধরনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মমতা। এদিন সন্ধ্যায় ৬টা নাগাদ টিডিপি নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু, আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠকের পরই প্রায় ৪৬ ঘণ্টা পর ধরনা তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা মমতার। তবে কলকাতার ধরনা শেষ হলেও দিল্লিতে নতুন করে এই ধরনা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তবে লড়াই যে এখানেই শেষ হচ্ছে না তাও জানান তিনি। মমতা বলেন ‘আমরা আমাদের সংগ্রাম থামাচ্ছি না। আমরা এটাকে দিল্লিতে নিয়ে যাচ্ছি।’

কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে রক্ষা করতে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলে ধরনায় বসেন মমতা ব্যানার্জি। অন্যদিকে কাজে বাধা দেওয়া এবং হেনস্তার অভিযোগে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। সিবিআই বনাম কলকাতা পুলিশের লড়াইয়ের মূলে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। মমতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে বাধা সৃষ্টি করে তাতে রাজনৈতিক রং লাগানোর অভিযোগে সরব কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দল বিজেপি। মমতা যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলেছেন তার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, ‘সারদা কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে ইউপিএ আমলে। সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। ফলে এতে এনডিএ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই।

অন্যদিকে সিবিআইয়ের দাবি, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করা হলে অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পাবে। প্রসঙ্গত, চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তকারী দলের প্রধান ছিলেন রাজীব কুমার। সেই তদন্তকারী দল গঠন করেছিল মমতা ব্যানার্জির রাজ্য সরকার। অভিযুক্তদের প্রায় সবাই রাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ। কেউ নেতা, কেউ মন্ত্রী। আইপিএস অফিসার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি আসলে অভিযোগের প্রমাণ লোপাট করেছেন। সারদা ঘটনায় মামলাকারী কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান ও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যরা শুরু থেকেই এই অভিযোগ করে আসছেন। সিবিআইয়ের তদন্তে রাজীব কুমারের অসহযোগিতার অভিযোগ আগেও জমা পড়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সেবার সুপ্রিম কোর্ট উভয় পক্ষকে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে বলেছিল। তখন রাজীব কুমার কলকাতার বিধাননগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন। বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনার। সিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক মাসে অনেকবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও রাজীব কুমার তাতে কোনো সাড়া দেননি। সিবিআই-এর বক্তব্য হলো, ‘গত কয়েক মাসে পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও তিনি আসেননি। তাই বাধ্য হয়েই তাঁর বাড়িতে যেতে হয়েছিল। সিবিআই আরও বলেছে, শুধু রাজীব কুমার নন, তালিকায় নাম আছে আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তার।

ওদিকে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। রাজ্যপালের রিপোর্ট হাতে এলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্র। এখানেই অনেকে মনে করছেন, বাংলায় আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার অজুহাতে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার বা শাসক দল বিজেপির তরফে তেমন কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।

এ ব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কাকলি ঘোষদস্তিদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছর ধরে নানাভাবে ভারতীয় সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে বিজেপি সরকার। শুধু বাংলা নয়, সব রাজ্যেই কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে বিরোধীদের জব্দ করার অপচেষ্টা চলছে। মনে রাখতে হবে, রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টিতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। আগামী ১৩ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে না সিবিআই। তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের অঙ্গুলি হেলনে সিবিআইয়ের ৪০ জন অফিসার রাতের অন্ধকারে শহরের পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে চড়াও হয়েছেন। ওঁরা আদালতের নির্দেশ অবমাননা করেছেন।’

তবে অনেকেই বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে সবরকম সহযোগিতা করা উচিত। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সমস্যায় সম্ভবত রাজনৈতিক সমাধান বা বোঝাপড়ার আর জায়গা নেই। লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। তবে সাংবিধানিক সংকট হলে আদালতে মীমাংসা হতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি শুনতে চেয়েছে। তাই আদালতের দিকেই নজর রাখতে হবে। অবস্থান ধর্মঘটে তেজস্বী যাদব, কানিমোঝি : কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে গতকালও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থান কর্মসূচি চলছে। মমতা ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের পাশে আছেন। মমতাকে সমর্থন জানাতে কলকাতায় এসেছেন বিহারের আরজেডি দলের নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী যাদব ও ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি। মমতা অবস্থান মঞ্চ থেকে সচিবালয়ের সব কাজ করছেন। মন্ত্রিসভার সভা করছেন। নির্দেশ দিচ্ছেন। পুলিশের পদক দেওয়া অনুষ্ঠানও করছেন। মমতা গত সোমবার বলেন, ‘আমি চিরকাল যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কাজ করেছি। কী করবে ওরা? ৩৫৫, ৩৫৬ জারি করবে? আমার কাছে আছে ১৪৪ ধারা। নো অ্যান্ট্রি বোর্ড লাগিয়ে দেব। আর যারা বলে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা নেই, তাদের মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দেওয়া দরকার।’

মমতার অবস্থান কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করতে সোমবারই কলকাতায় এসেছেন বিহারের আরজেডি দলের নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী যাদব এবং ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি। অবস্থান মঞ্চে এসে তেজস্বী যাদব বলেছেন, ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের খেলায় মেতেছে বিজেপি। বিজেপির এই প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা মমতার পাশে আছি।’ ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি বলেছেন, মমতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার জন্য তিনি সুদূর চেন্নাই থেকে ছুটে এসেছেন। তিনি চান মমতার পাশে থাকতে।

সর্বশেষ খবর