শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সুয়েজ খালের বিকল্প নিয়ে ফের কথা

আলোচনায় ইসরায়েল রুট

সুয়েজ খালের বিকল্প নিয়ে ফের কথা

দানবাকৃতি এভার গিভেন জাহাজ। গত ২৩ মার্চ এটি সুয়েজ খালে আড়াআড়ি আটকে যায়। ব্যস, বন্ধ হয়ে যায় ছয় দিনের জাহাজ চলাচল। আর্থির ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু এর সুদূর প্রসারী পরিণতি যে কত গুরুতর হতে পারে মিসর হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে তা বোঝেনি। এর কারণ লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগকারী ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। বিশেষ করে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের একটি লাইফ-লাইন হলো মিসরের এই খালটি। কিন্তু অর্থের এই লোকসানের চেয়ে অন্য আরেকটি বিষয় এখন হয়তো মিসরের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেটি হলো, দুর্ঘটনার পর নতুন করে সুয়েজ খালের বিকল্প একটি খালের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা শুরু। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে বিজনেস ইনসাইডার নামে একটি পত্রিকায় ১৯৬৩ সালের একটি গোপন সরকারি নথি প্রকাশ করা হয় যেখানে সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে ইসরায়েলের ভিতর দিয়ে একটি খাল তৈরির পরিকল্পনার কথা ছিল। আমেরিকার বাণিজ্য দফতরের গোপন ওই নথি ১৯৯৬ সালে আংশিকভাবে প্রকাশ করা হয়। আমেরিকার ওই গোপন পরিকল্পনায় ১৬০ মাইল লম্বা একটি খাল খননের জন্য ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমির তলায় ৫২০টি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করার কথা বলা হয়েছিল। বিজনেস ইনসাইডারের রিপোর্টটি বিশেষ করে ইসরায়েলের মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। তেমন একটি খাল তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে ইসরায়েলি মিডিয়ায় বিশ্লেষণ-মন্তব্য শুরু হয়েছে। এর মধ্যে লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ান বৃহস্পতিবার তাদের এক রিপোর্টে ব্রিটেনের সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে বলছে যে সুয়েজ খালে দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল এবং মিসরের সীমান্ত দিয়ে নতুন একটি খাল তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে জাতিসংঘের বাণিজ্যিক-রুট সম্পর্কিত কমিটিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। গার্ডিয়ানের রিপোর্ট বলছে, কয়েক বছর আগে জাতিসংঘ টানেল তৈরিতে বিশেষজ্ঞ একটি কোম্পানিকে দিয়ে সুয়েজের বিকল্প একটি খালের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল, যেখানে ওই কোম্পানি বলেছিল যে পাঁচ বছরে এমন একটি কৃত্রিম খাল তৈরি করা সম্ভব। লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সামি হামদি বলেন, সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ এবং তা সম্ভব না হলে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির পরিকল্পনা ইসরায়েল বহুদিন ধরেই করছে। আর তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে আমেরিকা এবং পশ্চিমা অনেক দেশের। “১৯৫৬ সালে ইসরায়েল সুয়েজের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সমর্থন নিয়ে মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিল। বাস্তবতার কারণে হয়তো বিষয়টি বারবার চাপা পড়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সেই আকাক্সক্ষা থেকে ইসরায়েল কখনই সরেনি’।

বিবিসি বাংলাকে বলেন সামি হামদি। এইলাট রেলপথ : খাল তৈরির বিকল্প হিসেবে ইসরায়েল সরকার ২০১২ সালে লোহিত সাগরে এইলাট বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগরে হাইফা বন্দর পর্যন্ত একটি রেললাইন প্রকল্প অনুমোদন করেছিল। পরিকল্পনা ছিল- এশিয়া থেকে জাহাজ এসে তাদের পণ্য এইলাটে খালাস করবে, তারপর পণ্য ট্রেনে করে হাইফায় নিয়ে ইউরোপগামী জাহাজে তোলা হবে। কিন্তু জাহাজ ব্যবসায়ীরা দুবার মাল ওঠানামার ঝামেলায় রাজি হবে কি না, এবং সেই সঙ্গে এইলাট বন্দর বাড়তি কর্মকান্ডের চাপ সহ্য করতে পারবে কি না, সেই সন্দেহ থেকে ওই পরিকল্পনা চাপা পড়ে যায়। সামি হামদি বলেন, আরব বসন্তের পর মিসরের আনুগত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমেরিকার এবং সেই সঙ্গে ইসরায়েলের মধ্যে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

বিকল্প খাল, মিসর এবং আরব বিশ্ব : কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মিসর সুয়েজের বিকল্প কোনো খাল তৈরিতে রাজি হবে কি না? সুয়েজ খাল থেকে বছরে মিসরের প্রায় ৬০০ কোটি ডলার আয় হয়, যা দেশটির জিডিপির দুই শতাংশের মতো। তবে সামি হামদি মনে করেন, মিসরের কাছে সুয়েজ খালের অর্থনৈতিক গুরুত্বই একমাত্র বিবেচ্য নয়। আঞ্চলিক ইস্যুতে প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে যতটুকু অস্ত্র মিসরের রয়েছে, সুয়েজ খাল তার অন্যতম। আমেরিকা যেসব কারণে মিসরকে গুরুত্ব দেয়, সেটির পেছনেও রয়েছে সুয়েজ খাল। “সুতরাং বিকল্প একটি খাল এবং এই জলপথের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া হবে মিসরের জন্য একটি বিপর্যয়। মধ্যপ্রাচ্যে মিসরের প্রভাব এবং গুরুত্ব দারুণভাবে মার খাবে।’ এ কারণেই গত সপ্তাহের সংকট দ্রুত নিরসনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল মিসর। একাধিক দেশ থেকে রাতারাতি বিশেষজ্ঞ উড়িয়ে আনা হয়েছিল। সারাক্ষণই আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে তারা জানিয়েছে এবং দেখিয়েছে যে কতটা গুরুত্ব দিয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। সামি হামদি মনে করেন, সুয়েজ খালের ওপর মিসরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে শুধু মিসর নয়, আমেরিকার ওপর চাপ তৈরির অবশিষ্ট যে গুটিকয় অস্ত্র আরব বিশ্বের রয়েছে, তাও ভোঁতা হয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর