পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এটি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে জারি করা একটি লিখিত ফরমান, কুরাইশ এবং ইয়াসরিবের মুমিন ও মুসলমান এবং যারা তাদের অনুগামী হয়ে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবে এবং তাদের সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে (তাদের জন্য)।
১. অন্য লোকজন থেকে তারা একটি স্বতন্ত্র উম্মাহ বা জাতি।
২. কুরাইশ মুহাজিররা তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য রক্তমূল্য পরিশোধ করবে এবং তারা তাদের বন্দিদের মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে মুক্ত করবে।
৩. বনু আউফ তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য রক্তপণ আদায় করবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
৪. বনু সায়িদাহ তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তপণ আদায় করবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
৫. বনু হারিস তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তপণ আদায় করবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
৬. বনু জুশম তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য তাদের পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তের মূল্য দেবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
৭. বনু নাজ্জার তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য তাদের পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তের মূল্য দেবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
৮. বনু আমর ইবন আউফ তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য তাদের পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তের মূল্য দেবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
৯. বনু নাবিত তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তের মূল্য পরিশোধ করবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
১০. বনু আউস তাদের পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য পূর্ব প্রদত্ত হারে রক্তের মূল্য পরিশোধ করবে এবং প্রত্যেক গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত দয়া ও ন্যায়বিচার মোতাবেক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করবে।
১১. মুমিনরা তাদের নিজেদের ঋণগ্রস্ত কাউকে ছেড়ে দেবে না; বরং মুক্তিপণ ও রক্তমূল্য আদায়ের জন্য সাহায্য করবে।
১২. কোনো মুমিন অন্য মুমিনের মাওলা বা আশ্রিতের সঙ্গে চুক্তি করবে না।
১৩. ধর্মভীরু মুমিনরা তাদের নিজেদের কেউ বিদ্রোহী হলে বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে থাকবে। তারা মুমিনদের মধ্যে অত্যাচার, পাপাচার, শত্রুতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধাচরণ করবে। প্রত্যেকের হাত তার বিরুদ্ধে থাকবে, যদিও অন্যায়কারী তাদের কারো সন্তান হয়।
১৪. কোনো মুমিন কাফিরের বদলায় কোনো মুমিনকে হত্যা করবে না এবং মুমিনের বিরুদ্ধে কাফিরকে সাহায্য করবে না।
১৫. আল্লাহর জিম্মা বা নিরাপত্তা একই। তা হলো, সর্বাপেক্ষা দুর্বলকে (অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে) আশ্রয় দেওয়া। মুমিনরা অন্যদের মোকাবিলায় একে অপরের বন্ধু।
১৬. ইহুদিদের মধ্য থেকে যারা আমাদের অনুসরণ করবে তাদের সাহায্য করা হবে এবং তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা হবে। তাদের ওপর অত্যাচার করা হবে না এবং তাদের শত্রুদের সাহায্য করা হবে না।
১৭. মুমিনদের চুক্তি একটাই। কোনো মুমিন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য মুমিন ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে চুক্তি করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই চুক্তি সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে না হয়।
১৮. যেসব যোদ্ধা আমাদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করবে তারা একে অন্যের পেছনে থাকবে।
১৯. মুমিনরা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় দেওয়া রক্তের শোধ নেবে।
২০. নিঃসন্দেহে ধর্মভীরু মুমিনরা সর্বোত্কৃষ্ট এবং সত্য ও সঠিক পথপ্রাপ্ত।
২১. কোনো মুশরিক (পৌত্তলিক) কোনো কুরাইশের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবে না এবং কোনো মুমিননের বিরুদ্ধে গিয়ে কুরাইশদের পক্ষাবলম্বন করতে পারবে না।
২২. যদি কেউ অন্যায়ভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তার প্রতিদানে সেও নিহত হবে, যদি না নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী (দেয় অর্থের বিনিময়ে) সন্তুষ্ট হয়। মুমিনরা সবাই হত্যাকারীর বিরুদ্ধে থাকবে। হত্যাকারীর বিরুদ্ধাচরণ ছাড়া মুমিনদের জন্য অন্য কিছু বৈধ নয়।
২৩. মুমিনরা যারা এই সনদের সঙ্গে একমত হয়েছেন এবং যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদের জন্য কোনো অন্যায়কারীকে সাহায্য কিংবা আশ্রয় প্রদান বৈধ হবে না। যদি কেউ অন্যায়কারীকে সাহায্য করে বা আশ্রয় দেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন তার ওপর আল্লাহর লানত ও গজব পড়বে। তার কাছ থেকে কোনো প্রকার অনুতাপ কিংবা বদলা গ্রহণ করা হবে না।
২৪. যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে আল্লাহ তাআলা এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর মতামতের প্রতি তা সমর্পণ করবে।
২৫. যত দিন যুদ্ধ চলবে ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যয় বহন করবে।
২৬. বনু আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। চাই তারা মাওয়ালি (আশ্রিত) হোক বা নিজেরা হোক। যদি কেউ অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তবে সে তার নিজের ও পরিবারের জন্য ক্ষতি করে।
২৭. বনু নাজ্জারের ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে।
২৮. বনু হারিছের ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে।
২৯. বনু সায়িদার ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে।
৩০. বনু জুশমের ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে।
৩১. বনু আউসের ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে।
৩২. বনু সালাবার ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে। কিন্তু যদি কেউ অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে সে তার নিজের ও পরিবারের জন্য ক্ষতি করে।
৩৩. সালাবা গোত্রের শাখা জাফনার ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু সালাবা ভোগ করবে।
৩৪. বনু শুতাইবার ইহুদিরা সেই অধিকার ভোগ করবে, যা বনু আউফের ইহুদিরা ভোগ করবে। বিশ্বাসঘাতকতার পরিবর্তে সততা কাম্য।
৩৫. সালাবার মাওয়ালি বা আশ্রিতরা সালাবা গোত্রের মতো অধিকার ভোগ করবে।
৩৬. ইহুদি গোত্রের শাখা-প্রশাখাগুলো ইহুদিদের মতো অধিকার ভোগ করবে।
৩৭. তাদের কেউ মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুমতি ছাড়া যুদ্ধের জন্য বের হবে না।
৩৮. কারো ক্ষতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না। কেউ যদি হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, তাহলে সে এবং তার পরিবার দায়ী হবে। যদি কেউ অত্যাচারিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা এই সনদের সর্বাধিক হিফাজতকারী।
৩৯. ইহুদিরা নিজেদের খরচ বহন করবে এবং মুসলমানরা নিজেদের খরচ বহন করবে।
৪০. এই সনদ গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করবে তাদের বিরুদ্ধে ইহুদি এবং মুসলমানরা একে অপরকে সাহায্য করবে। তাদের একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক হবে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ও কল্যাণকামিতামূলক এবং বিশ্বাসঘাতকতার পরিবর্তে সম্মানজনক ব্যবহার।
৪১. বন্ধুর দুষ্কর্মের জন্য কেউ দায়ী হবে না এবং অত্যাচারিতদের সাহায্য প্রদান করা হবে।
৪২. যত দিন যুদ্ধ চলবে ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করবে।
৪৩. এই সনদপত্রে অঙ্গীকারাবদ্ধ লোকদের জন্য ইয়াসরিবের উপত্যকা পবিত্র।
৪৪. আশ্রিতরা যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ধরনের অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আশ্রয়দানকারীদের মতো অধিকার ভোগ করবে।
৪৫. কোনো স্ত্রীলোককে তার পরিবারের অনুমতি ছাড়া আশ্রয় দেওয়া যাবে না।
৪৬. যদি এই সনদে অঙ্গীকারাবদ্ধ লোকদের মধ্যে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে তা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি (মীমাংসার জন্য) সমর্পণ করা হবে। এই সনদে যা কিছু আছে তার জন্য আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ যত্নবান।
৪৭. কুরাইশদের এবং তাদের সাহায্যকারীদের কোনোভাবেই আশ্রয় দেওয়া যাবে না।
৪৮. ইয়াসরিবের ওপর অতর্কিত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তারা (ইহুদি ও মুসলমানরা) একে অপরকে সহযোগিতা করবে।
৪৯. যদি তাদের চুক্তি করার এবং তা মেনে নেওয়ার আহবান জানানো হয়, তবে তারা চুক্তি করবে এবং তা মেনে নেবে। যদি মুমিনদেরও অনুরূপ বিষয়ে আহবান জানানো হয়, তাহলে তাদের দায়িত্ব হবে সেটা মেনে নেওয়া। যদি কেউ ধর্মের জন্য যুদ্ধ করে, তবে তা আলাদা ব্যাপার।
৫০. যে যেদিকে থাকবে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তার ভাগে সেদিক পড়বে।
৫১. বনু আউসের ইহুদিরা নিজেরা এবং তাদের আশ্রিতরা এই সনদের শরিক দলের মতো অধিকার ভোগ করবে, যদি তারা সনদের শরিক দলের সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করে। বিশ্বস্ততা বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ। যে এটা আয়ত্ত করে সে নিজের জন্য করে। এই সনদে যা কিছু আছে আল্লাহ তার সত্যতার সাক্ষী ও রক্ষাকারী।
৫২. অত্যাচারী কিংবা পাপী ছাড়া এই সনদ বাস্তবায়নে কেউ বাধা প্রদান করবে না। যে কেউ যুদ্ধের জন্য বের হবে সে নিরাপদে থাকবে। আর যে মদিনায় বসে থাকবে সে নিরাপদে ও শান্তিতে থাকবে। যারা অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতা করবে তারা এর ব্যতিক্রম।
৫৩. নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎ ও ধর্মভীরুদের রক্ষাকারী এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।
(সূত্র : তাহজিব সিরাতু ইবন হিশাম, আবদুস সালাম হারুন (সম্পা.), কুয়েত : দার আল-বুহুস আল-ইসলামিয়্যাহ)।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ